বাংলা সাহিত্যের সহজ মোড়কে জড়ানো এক জটিলতম ভাবের গল্প এই পুতুলনাচের ইতিকথা। পুতুলনাচের ইতিকথা নানা রকম জীবনের গল্প বলে। জীবনের গতিময় ছবি এঁকে পরিবর্তনকে উপলব্ধি করায়। জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায়। এটা মূলত গ্রামের মানুষের জীবনের গল্প হলেও গ্রাম এবং শহরের মানুষের জীবন আমরা কোথাও কোথাও এক বিন্দুতে মিলিত হতে দেখি। কারণ সবাই মানুষ। সবাইকেই পুতুলের মত খেলাচ্ছেন কোন অদৃশ্য হাত।
পুতুলনাচের ইতিকথা একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। উপন্যাসের ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু গাওদিয়া গ্রাম ও এই গ্রামের মানুষজন। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সহজাত বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও মননশীলতার প্রাধান্যে গ্রামীণ জীবন অবলম্বনে রচিত ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি। এখানে পুতুলনাচের কথা সরাসরি কোথাও বর্ণিত হয়নি – তবে পুতুল কথাটি এবং পুতুল খেলার প্রসঙ্গ একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে।
পুতুলনাচের ইতিকথাকে মহান করেছে তার কাহিনীর বাস্তবতা। বাস্তবতাকে অনুধাবন করা যেমন সহজ নয়, বাস্তবতার গল্প সহজভাবে বলাও তেমন সহজ কাজ নয়। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ছবি পথের পাঁচালী, সাধারণ গ্রামীণ বাস্তবতার ছবি, কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখে।
সদ্য ডাক্তারি পাস করা শশীকে ঘিরে পুতুলনাচের ইতিকথা বইটির মূল কাহিনি। মানুষের নানা ধরণের আবেগ অনুভূতি নিয়ে খেলা একটি চমৎকার ক্লাসিক গল্প হচ্ছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। বইয়ের নামকরণও বেশ ভালো লেগেছে, নিয়তির হাতে এই উপন্যাসের সবাই যেন পুতুল, সেই পুতুলনাচের ইতিকথাই শোনানো হয়েছে এই গল্পে।
পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক তরুণ। ডাক্তারি পাস করে নিজ গ্রামে ফিরে এসে মানুষকে সেবা দিচ্ছে। গ্রামে একটা লাইব্রেরি পর্যন্ত নেই। চারিদিকে অশিক্ষিত, কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ। গ্রামের জীবনে হাঁপিয়ে ওঠে সে, গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কথা তার বারবার মনে হলেও এক তরুণীর দ্ব্যর্থক ইশারা তাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে রাখে।
অন্যদিকে বইয়ের অপর চরিত্র যাধব নিজেকে মহাপুরুষ প্রমাণ করতে যেয়ে নিজেই বিপদে পড়ে যায়। যার সর্বশেষ পরিণতি হয় নিজ ইচ্ছায় মৃত্যু। যাধবের মতো রহস্যময় মানুষের রহস্য সত্য-মিথ্যায় জড়ানো। যাধবের মিথ্যা চিরকালের জন্য সত্য হয়ে যায় তার মৃত্যুর মাধ্যমে। তবে যাধবের মৃত্যুর জন্য কী শশীকে দায়ী করা যায়? মনে হয়, আবার মনে হয় না।
শশীর বন্ধু কুমুদ। কুমুদকে আসলে জগতের জন্য সহনশীল করে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সে সবকিছুতেই আনন্দ আনন্দ খুঁজে পায়। জগতের কোনো দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারে। প্রকৃত সুখী যাকে বলে। মতিকে কী দারুণভাবে বশ করিয়ে নিয়েছে তার জীবনের সাথে। সত্যি বলতে কুমুদকে আমার খুব ভালো লেগেছে।
বইয়ের নারী চরিত্র কুসুমকে গ্রাম বা শহরের সাধারণ আর দশটা তরুণীর সাথে তুলনা করলে অন্যায় করা হবে। সে অকপট মিথ্যা কথা বলে, ধরা পড়লে দুষ্টু হাসিতে মেনে নেয়; নিষিদ্ধ কথা বলতে পারে অবিচলিতভাবে, কথোপকথনের সুর সেই ঠিক করে দেয়, সেই নিয়ন্ত্রণ তার আশেপাশের হাওয়া, তার আত্মবিশ্বাসকে সবাই সমীহ করে, ভয় করে। বুঝতেই পারছেন ছলাকলায় পটিয়সী কুসুমের মুখের কথা যেকোনো তরুণ পাঠককেও রোমান্সের মেঘের উপর ভাসিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র জন্য মৃত্যু এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ, যে বইয়ের শুরু হয় এক আচমকা মৃত্যু দিয়ে। তারপর একেক রূপে দেখা দেয় মৃত্যু—কখনও গ্রামজীবনের দৈনিক, প্রায় একঘেয়ে বাস্তবতা হিসেবে, কোথাও অসুখ হয়ে, কোথাও দুর্ঘটনা হয়ে।
শশীর নিজের সত্ত্বার সাথে নিজের দ্বিমুখীতা, কুসুমের মন হঠাৎ করে মরুভূমির মতো শুকিয়ে যাওয়া, নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা পরান, গোপালের এমন অদ্ভুত স্বার্থপরতা, গ্রামের কিশোরী মেয়ে মতির হঠাৎ সংসারী হয়ে ওঠা, কুমুদের এমন ভবঘুরে জীবন কিংবা জয়ার সেই ভালোবাসা কি সবকিছু মিলিয়ে পুতুলনাচের ইতিকথার গাঁথা রচনা করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন যে, মানুষের সামগ্রিক প্রয়াস, ইচ্ছা বাসনার পূর্ণতা কিংবা অপূর্ণতার পরিণাম তার নিজের হাতে নেই। এক অজ্ঞাত শক্তির অমোঘ পরিচালন – নির্দেশের কাছে মানুষের ভূমিকা নিছক পুতুলের।
To read more blogs, click here.
Writer
Muhammed Mahadi Hasan
Intern
Content Writing department, YSSE