The image shows a comparison between two books and their film adaptations. On the left are covers of "Noukadubi" and "Chokher Bali" books. On the right are the corresponding movie posters, "Kashmakash" and "Chokher Bali," featuring characters in traditional attire. Bengali text highlights adaptation themes.

ঋতুপর্ণ ঘোষ—বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকর
ঋতুপর্ণ ঘোষ—বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকর, যিনি শব্দের সীমানা পেরিয়ে দৃশ্যকল্পের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতেন। সাহিত্যকে যখন তিনি সেলুলয়েডের ফিতায় বাঁধতেন, তখন তা কেবল গল্পের প্রতিধ্বনি থাকত না, বরং জন্ম নিত এক নতুন আখ্যানের।

বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিজগৎকে তিনি যেভাবে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন, তা যেন চিরাচরিত পাঠের বাইরে এক স্বপ্নিল পুনর্সৃষ্টি।
ঋতুপর্ণের স্পর্শে রবীন্দ্রনাথের পরিচিত আঙিনা যেন এক নতুন রহস্যময় উদ্যানে রূপান্তরিত হয়েছিল।

আমরা সাধারণত রবীন্দ্রনাথকে দেখি এক শান্ত, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় স্নাত কবিরূপে
প্রণয়, প্রকৃতিপ্রেম আর মানবমনের সূক্ষ্ম অনুভূতি যাঁর কবিতার পরতে পরতে মোড়ানো।

কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ সেই চেনা চিত্রের বাইরে গিয়ে আমাদের দেখালেন অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে।
তাঁর ছবিতে আমরা প্রবেশ করি এমন এক জগতে, যেখানে সম্পর্কের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকে জটিল মনস্তত্ত্বের ঘূর্ণি,
যেখানে চাপা আকাঙ্ক্ষার দীর্ঘশ্বাসেরা ভিড় করে,
আর সমাজের কঠিন বাস্তবতার প্রতি থাকে এক নীরব অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত।

‘চোখের বালি’ কিংবা ‘নৌকাডুবি’র মতো চলচ্চিত্রগুলি কেবল সাহিত্যকে অনুসরণ করেনি, বরং এই উপন্যাসগুলির এক নতুন, গভীরতর ভাষ্য তৈরি করেছে, যা আজও আমাদের ভাবায়, আমাদের স্পর্শ করে।

‘চোখের বালি’তে বিধবা বিনোদিনীর চরিত্রটি ঋতুপর্ণের হাতের ছোঁয়ায় যেন নবজন্ম লাভ করল।
রবীন্দ্রনাথের কলমে বিনোদিনী যে তীব্র বাসনা আর নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি ছিল, ঋতুপর্ণ তাকে আরও বলিষ্ঠ, আরও স্পষ্ট করে তুললেন।
কেবল পুরুষের চোখে দেখা এক নারী নয়, বিনোদিনী হয়ে উঠল এক স্বতন্ত্র সত্তা—যার নিজস্ব স্বপ্ন আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে,
আর সমাজের অচলায়তনের বিরুদ্ধে তার নীরব অথচ শক্তিশালী বিদ্রোহ বিদ্যমান।

ঐশ্বর্য রাই বচ্চনের মুগ্ধ করা অভিনয় এবং ঋতুপর্ণের সংবেদনশীল পরিচালনা বিনোদিনীকে কেবল করুণার পাত্রী হিসেবে না দেখিয়ে, তার ভেতরের আলো-আঁধারি জগৎটিকে জীবন্ত করে তুলল।

‘নৌকাডুবি’র পরিচিত প্রেক্ষাপট ও চরিত্ররা যখন ঋতুপর্ণের ‘কাশ্মকাশ’-এ ধরা দিল
তখনও যেন এক নতুন সুর বাজল।

অপ্রত্যাশিত ঘটনার ঘনঘটা এবং সম্পর্কের জটিল জালকে তিনি যেভাবে রূপ দিলেন, তা মূল গল্পের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল।

বিশেষত নারী চরিত্রগুলির অন্তর্নিহিত ভাবনা এবং তাদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন ঋতুপর্ণের পরিচালনার এক অসাধারণ দিক।

ঋতুপর্ণ ঘোষের দৃষ্টি ছিল যেন এক প্রখর আলোকরশ্মি
যা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির গভীরে প্রবেশ করে তার অনাবিষ্কৃত দিকগুলিকে আলোকিত করত।

তিনি কেবল গল্পের কাঠামো ধরে চলেননি, বরং প্রতিটি চরিত্রের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করতেন, তাদের না বলা কথাগুলিকে দৃশ্যের ভাষায় প্রকাশ করতেন।
তাঁর চলচ্চিত্রে সংলাপ, দৃশ্যসজ্জা এবং সঙ্গীতের ব্যবহারও ছিল এক ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম।

রবীন্দ্রনাথের গানগুলি তাঁর ছবিতে এক মায়াবী আবহ তৈরি করত, যা গল্পের মূল সুরটিকে আরও গভীর ও মর্মস্পর্শী করে তুলত।

ঋতুপর্ণের কাজের সৌন্দর্য এখানেই যে তিনি রবীন্দ্রনাথের চিরাচরিত ভাবনার বাইরে গিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।
তিনি দেখিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ কেবল প্রেমের কবি নন, প্রকৃতির রূপকার নন, বরং তাঁর লেখায় সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনসংগ্রাম, তাদের সম্পর্কের জটিলতা এবং অন্তর্নিহিত সত্যও প্রচ্ছন্ন রয়েছে।

তাঁর চলচ্চিত্রে নারী চরিত্ররা কখনোই গতানুগতিক দুর্বল বা অসহায় রূপে আসেনি। বরং তারা ছিল আত্মবিশ্বাসী, আবেগপূর্ণ এবং নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের সাহস রাখে—এমন এক প্রগতিশীল দৃষ্টিকোণ ঋতুপর্ণের রবীন্দ্রনাথের চিত্রায়ণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ঋতুপর্ণ ঘোষের এই সৃজনশীল ‘পুনর্সৃষ্টি’
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে এক নতুন বিস্ময় রূপে উন্মোচিত করেছে।
যারা হয়তো কেবল বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে রবীন্দ্রনাথকে জেনেছে, তারা ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির এক ভিন্ন, গভীরতর আস্বাদ পেয়েছে।

এই চলচ্চিত্রগুলি কেবল বিনোদন দেয়নি, বরং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে এবং তার অন্তর্নিহিত বার্তাগুলিকে অনুভব করতে সাহায্য করেছে।

পরিশেষে
ঋতুপর্ণ ঘোষ কেবল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ক্যামেরার ফ্রেমে বাঁধেননি, বরং তিনি সেই সাহিত্যকে আপন কল্পনাশক্তির রঙে রাঙিয়ে এক নতুন জীবন দান করেছিলেন।

তাঁর কাজের মাধ্যমে আমরা এক ‘অন্য’ রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করি—
যিনি একইসাথে আধুনিক এবং চিরায়ত, যিনি আমাদের সমাজের অলিগলিতে লুকিয়ে থাকা জটিলতাকে এবং মানুষের মনের গভীরে প্রবহমান আবেগগুলোকে স্পর্শ করতে জানেন।

ঋতুপর্ণের এই সাহসী এবং সংবেদনশীল প্রয়াস বাংলা চলচ্চিত্র এবং সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই এক অমূল্য সম্পদ।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখক,
ঈষিতা তাবাসচ্ছুম মৌ,
ইন্টার্ন,
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট,
YSSE