“শহর, শহর, ঢাকা শহর
আজব শহর ঢাকা!
এই শহরে আছে, অনেক গলি আঁকাবাঁকা।”
কবি শামসুর রহমানের পংক্তিগুলো যেন সত্য হয়ে ওঠে ঢাকা শহরের প্রতিটা অলিগলিতে। ঢাকা আসলেই একটি আজব শহর। শহর একটাই কিন্তু রয়েছে শত রকমের ভিন্নতা।
তবে কাগজে-কলমে লেখা না থাকলেও ঢাকাকে সবাই ‘পুরান ঢাকা’ আর ‘নতুন ঢাকায়’ ভাগ করে ফেলেছে। ওয়ারী, গুলিস্তান, চাঁনখারপুল, বকশিবাজার, আজিমপুর পেরোলেই দেখা মেলে পুরান ঢাকার। এসব এলাকা বাদে বাকি সবই নতুন ঢাকা।
কারণটা অবশ্য খুবই সহজ ! ঢাকার পুরনোতম অংশ, নাম তাই পুরান ঢাকা। কিন্তু নতুন ঢাকার সাথে বয়সের তুলনায় যদি না-ও যান, তবু একে যথেষ্ট ‘পুরান’-ই বলতে হবে। চারশো বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ এলাকাকে ‘পুরান’ মানা ছাড়া উপায়-ই বা কী!
কত শত সুরম্য অট্টালিকার ভিড়ে বাকি ঢাকায় যখন গভীর রাতে শুনশান নীরবতা।তখনো জেগে থাকে পুরান ঢাকার প্রতিটি অলি-গলি। ভোজন রসিকদের জন্য বিখ্যাত জায়গা পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি অলি-গলিতে সারারাত চলে জিভে জল আনা নানা খাবারের আয়োজন। বাঙালির রসনা তৃপ্তি মেটাতে জেগে থাকে পুরান ঢাকার অলি-গলি, সেইসঙ্গে অসংখ্য মানুষও।
কেউ কাজে, কেউ ঘুরতে আবার কেউ মুখরোচক খাবারের স্বাদ নিতে পুরান ঢাকায় যান। প্রায় সারারাতই রাজধানীর অন্যান্য এলাকা থেকে পুরান ঢাকার খাবার চেখে দেখতে ছুটে আসেন ভোজন রসিকেরা। এখানকার ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাগুলোও সারারাতই থাকে উৎসবের আমেজ। তাই ভূরিভোজের জন্য পুরান ঢাকার জুড়ি মেলা ভার।
কিন্তু পুরান ঢাকায় খেতে গিয়েছেন অথচ নাজিরা বাজার আর কাজে আলাউদ্দিন রোডের নাম শুনলে পাক চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া আসলেই দুষ্কর! কিংবা কখনোই নামে না চিনলেও হাজির বিরিয়ানি অথবা বিউটি লাচ্ছির নাম বললে নিশ্চয়ই চেনা যাবে! আসলে পুরান ঢাকায় দর্শনীয় স্থানে কোন অভাব নেই তারপরও নাজিরা বাজারকে কেন যেন একটু আলাদা করেই দেখা হয়। বেশিরভাগ মানুষই মূলত ভুরিভোজ এর জন্যই এই জায়গায় ঘুরতে যায়। শুধু সে মজা মজার খাবার পাওয়া যায় তা নয় কিংবা শুধু পুরনো বললেও ভুল হবে। এখানকার খাবার আসলেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ইতিহাসকে। সেই সূত্রে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী দুটি শব্দই নাজিরাবাজারের জন্য প্রযোজ্য!
পুরান ঢাকার এই নাজিরাবাজারে দিনরাত সবই সমান। ২৪ ঘণ্টাই এখানকার খাবার দোকানগুলো খোলা থাকে। এজন্য ই বলা হয়ে থাকে পুরান ঢাকা কখনো ঘুমায় নাবিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনায় সারাক্ষণ মুখর থাকে এলাকাটি। ভোজনরসিক মানুষের কাছে এলাকাটি এক ভালোবাসার নাম। দিনের যেকোনো সময় গেলেই সেখানে মেলে মুখরোচক বিভিন্ন খাবার।
তবে আমরা কি জানি এই জায়গার নাম আসলেই কেন নাজিরা বাজার?
কথিত আছে, ঢাকায় মোগল আমলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নাজিরেরা সেখানে বসবাস করতেন। নাজিরদের বসবাসের এলাকায় বাজারটি গড়ে ওঠে বলে এর নাম হয় নাজিরাবাজার।
ঐযে কথায় আছে না, সকালে নেহারি, দুপুরে তেহারি, সন্ধ্যায় লাচ্ছি আর রাতে কাচ্চি—এই হচ্ছে পুরান ঢাকার ভোজনরসিক মানুষের খাবার।
নাজিরাবাজার ও তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানে লাল কাপড়ে মোড়ানো একেকটি বিরিয়ানির ডেক দেখলে স্বর্গের কথা মনে পড়বে। বিরিয়ানি, কাবাব, বোরহানি, হালিম, মোরগ পোলাও, গরুর কালা ভুনা থেকে শুরু করে কী নেই সেখানে?
খাবারের সুঘ্রাণে অপার্থিব অনুভূতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানির প্লেট, এক টুকরো লেবু ও এক পিস কাঁচা মরিচ আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক ভুবনে। ভারী খাবার খাওয়ার পর কিছুটা মিষ্টিমুখ না করলে মিস হয়ে যাবে। তাই লাচ্ছি, ফালুদা, মিষ্টি পান খেয়ে খাওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ করে নিতে হবে।
নাজিরাবাজারে খেতে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাত যত গভীরই হোক সেখানে গরম খাবার পাওয়া যাবে, সেটা নিশ্চিত। শুধু পুরান ঢাকার মানুষই নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকেও ভোজনরসিক মানুষজন সেখানে ভিড় জমান।
কেউবা আরাম করে খেতে কেউবা সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে আড্ডা দিতে উপস্থিত হন সেখানে; বিশেষ করে পেশাগত কারণে যাঁদের রাতে বাইরে অবস্থান করতে হয়, তাঁদের জন্য নাজিরাবাজার এক ভরসার জায়গা। এ যেন রথ দেখা আর কলা বেচার মতো অবস্থা—পুরান ঢাকায় বসে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারও খাওয়া হলো আবার ভালো একটা সময়ও কাটল।
এমন কি নাজিরাবাজারের বিখ্যাত খাবারের স্বাদ নিতে বিদেশিরাও এখানে ছুটে যান ! ২০১৯ সালে বিখ্যাত বিরিয়ানির স্বাদ নিতে নাজিরাবাজারে এসেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। তিনি সেখানকার বিরিয়ানি খেয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
নাজিরাবাজারে পুরোনো দোকানগুলোর মধ্যে অন্যতম হাজি বিরিয়ানি, হানিফ বিরিয়ানি ও বিসমিল্লাহ কাবাব এছাড়া আর নামকরা প্রায় ৪০-৫০ টি বিরিয়ানির দোকান ও হোটেল। এ ছাড়া সেখানে খেতে আসা মানুষদের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন অনেক দোকান খোলা হচ্ছে, আছে সি ফুডও। ফলে ঐতিহ্যবাহী খাবার থেকে শুরু করে বর্তমানের ট্রেন্ড সামুদ্রিক খাবার—সব পাওয়া যাবে নাজিরাবাজারে।
পাশাপাশি আছে বিউটি লাচ্ছি, সোহেল আলি চা, জান ভাইয়ের আগুন ফুচকা, দিল্লির শাহী মিঠা পান, আল করিম জুসসহ ৫-৬টি চা, পান ও পানীয়ের দোকান। গভীর রাত পর্যন্ত এসব দোকানে আড্ডায় মেতে থাকেন তরুণরা। কাজী আলাউদ্দিন রোড, বংশাল, ফ্রেন্স রোড এলাকা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী নাজিরাবাজার এলাকা। মূলত এই তিন সড়কেই বাংলাদেশের সেরা সেরা বিরিয়ানি ও কাবাবের দোকানগুলো।
তবে সাধারণত ঢাকার রাজপথে নারীদের জন্য রাতের বেলায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও নাজিরাবাজার সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে নারীরাও এখানে আসেন নির্বিঘ্নে।
তাহলে কোন এক রাতে বা দিনে পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার হতে পারে আপনার গন্তব্য! কারন পুরান ঢাকা কখনো ঘুমায় না!
এরকম আরো ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন এখানে
লেখক,
মাফরুহা সুমাইয়া,
ইন্টার্ন ,
কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট ,
YSSE