মানুষ কত বছর বাঁচে? এর নির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই। স্থান, কাল, জাতিসত্ত্বা খাদ্যাভাস, জীবনযাপনের ধরন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সেই সংখ্যাটি হতে পারে নানা রকমের। আমাদের দেশের কথাই যদি ধরি, বর্তমানে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর। এই সংখ্যাটি পরিবর্তিত হয়ে জাপানে ৮৩ বছর, সিঙ্গাপুরে ৮৩.১ বছর আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯০ বছর। এদিকে আমাদের দেশেই অনেক শতবর্ষী প্রবীণ আছেন। তবে সঠিক প্রমাণপত্রের অভাবে সেগুলোর সত্যতা যাচাই সম্ভব নয়। প্রমাণপত্রসহ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়স্ক নারী হলেন জিন ক্যালমেন্ট।

 

জীন ক্যালমেন্টের জীবন বৃত্তান্ত 

 

সময়টা ১৮৭৫ সাল। ফ্রান্সে তখনো আইফেল টাওয়ার নির্মাণ করা হয়নি। সেবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের আর্লেসে মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেন জীন ক্যালমেন্ট। বাড়িতেই পড়াশোনার হতেখড়ি হয় তাঁর। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন মিসেস বেনেটের চার্চ প্রাইমারি স্কুলে, স্থানীয় কলেজ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা, তারপর ব্রেভেট ক্লাসিক এর উপর ডিপ্লোমা নিয়ে ১৬ বছর বয়সে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত জিন ক্যালমেন্ট পিয়ানো বাজানো আর চিত্রাঙ্কন শিখায় মনোনিবেশ করেন।

 

২১ বছর বয়সে তিনি তার চাচাতো ভাই ফার্নান্ড নিকোলাস ক্যালমেন্টকে বিয়ে করেন। মজার ব্যাপার হলো তাদের পিতামহরা ছিলেন ভাই, এবং তাদের পিতামহীরা ছিলেন বোন। ফার্নান্ড নিকোলাস ছিলেন আর্লেসের একজন নামকরা ব্যবসায়ী। ফার্নান্ড-জিন দম্পতি একটি বিশাল বাড়িতে বসবাস করতেন। সে বাড়িতে ছিলো পর্যাপ্ত চাকর ফলে জিনকে কখনও গৃহস্থালী কাজ করতে হয়নি। ফেন্সিং, সাইকেল চালানো, টেনিস, সাঁতার কাটা, রোলারস্কেটিং, পিয়ানো বাজানো এবং বন্ধুদের সাথে সঙ্গীত চর্চা সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন জিন। ১৯ জানুয়ারী ১৮৯৮ সালে তার একমাত্র কন্যাসন্তান, ইভন মারি নিকোল ক্যালমেন্টের জন্ম হয়।

 

ইভন তার ৩৬ তম জন্মদিনে প্লুরিসি রোগে মারা যান। এদিকে ১৯৪২ সালে, তার স্বামী ফার্নান্ড, ৭৩ বছর বয়সে বিষক্রিয়ার ফলে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর নাতির সাথেই থাকতেন জিন। ১৯৬৩ সালে নাতির মৃত্যুর পর তিনি পুরোপুরি একা হয়ে পরেন। ১৯৮৫ সালে, তিনি একটি নার্সিং হোমে চলে যান, তারপর সেখানেই ১১০ বছর বয়স পর্যন্ত থেকেছিলেন। জিন ক্যালমেন্ট ৪ আগস্ট, ১৯৯৭ তারিখে তার নিজ শহর আর্লেসে সকালবেলায় স্বাভাবিক ভাবেই মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ১২২ বছর।

 

স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন 

 

জিন তার দীর্ঘ জীবনের পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং নিয়ম মাফিক ব্যায়াম। তিনি সবসময় অলিভ অয়েল সমৃদ্ধ খাবার খেতেন এবং পাশাপাশি তেলটি তার ত্বকে ব্যবহার করতেন। এছাড়া তার খাদ্য তালিকায় থাকতো কফি, সিদ্ধ মাছ অথবা মাংস, ডার্ক চকলেট, ওয়াইন, ডেজার্ট।

 

জিন ১১০ বছর বয়সের পর নিজেকে আরো কঠিন নিয়মে আবদ্ধ করেন। তার সেখানকার রুটিন ছিল খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, প্রার্থনা করা, নিয়মমাফিক খাবার খাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, গান শোনা এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া। জিন দাবি করেছিলেন যে তিনি কখনও গুরুতর অসুস্থ হতেন না। শুধু হার্টের সমস্যার কারণে ১১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম হাসপাতালে ভর্তি হন।

 

গিনেস ওয়ার্ড রেকর্ড ও অন্যান্য 

 

জিন ১১২ বছর বয়সে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস দ্বারা বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৯৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারি সি. হোয়াইট ১৮৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে দাবি করার ফলে তিনি এই খেতাবটি হারান। ১৯৯১ সালে হোয়াইটের মৃত্যুর পর, পুনরায় জিন ক্যালমেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত ব্যক্তির খেতাব ফিরে পান।

 

১১৪ বছর বয়সে তিনি একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার নাম ভিনসেন্ট এন্ড মি। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। তার জীবন সম্পর্কে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম, বিয়ন্ড ১২০ ইয়ারস ওইথ জিন ক্যালমেন্ট, যেটি ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায়।

 

জিন ক্যালমেন্টের পরিবারেও বেশ কয়েকজন দীর্ঘায়ু মানুষ ছিলেন। তাঁর বড় ভাই ফ্রাঙ্কোইস ৯৭ বছর, তাঁর বাবা নিকোলাস ৯৩ এবং তার মা মার্গুরাইট গিলস ৮৬ বছর বয়স পর্যন্ত বেচেঁছিলেন। ফলে বলা যায়, জিনের দীর্ঘজীবী হওয়ার পিছনে তার পারিবারের একটা অবদান আছে। এখন পর্যন্ত অনেকেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু মানুষ প্রমাণ করারধ চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তারা আধুনিক মানদন্ডে সেগুলো প্রমাণ করতে পারেননি। একমাত্র জিন ক্যালমেন্ট-ই আধুনিক মানদন্ডে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু মানুষ হিসেবে স্বীকৃত।

 

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।

 

লেখক :

খায়রুল ইসলাম শুভ

ইন্টার্ন

কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE