প্রতিটি মানুষের জীবনেই ব্যর্থতা আসে। কোনও বড় স্বপ্নই একবারে পূরণ হয় না। এটা জীবনেরই একটা অংশ। পৃথিবীতে অসাধারণ সাফল্য সেইসব মানুষই অর্জন করতে পারেন, যাঁরা বার বার ব্যর্থ হয়েও চেষ্টা করে যান। একবার ব্যর্থ হলে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁরা আবার শুরু করেন।তারপর আবার ভুল করেন, আবার শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এভাবে শত শত বা হাজার হাজার বার ব্যর্থ হতে হতে একটা সময়ে গিয়ে তাঁরা সফল হন। বদলে দেন পৃথিবীর ইতিহাস।এরকমই পৃথিবীর সেরা ১০ জন সফল মানুষের ব্যর্থতার অনুপ্রেরণামূলক গল্পের প্রথম পর্বের পরবর্তী অংশটি এই পর্বে তুলে ধরা হলো।
০৬. কনোনেল স্যান্ডার্স
কেএফসির লোগোটির ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা হাসিমুখের লোকটিই কনোনেল স্যান্ডার্স। তিনি কেএফসি নামক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় ফাস্টফুড চেইনের প্রতিষ্ঠাতা। এতবড় কোম্পানী যাঁর রেসিপি থেকে শুরু, সেই রেসিপি বিক্রী করতে তাঁকে ১০০৯ বার ব্যর্থ হতে হয়েছিল।
৫ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর থেকে তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। নিজের রান্নার দক্ষতার কারণে কাজ পেতে কখনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যখনই নিজে কিছু করতে গেছেন – তখনই ব্যর্থ হয়েছেন। ১৯৩৯ সালে ৪৯ বছর বয়সে অনেক কষ্টে একটি মোটেল শুরু করেন। মোটেলটি ৪ মাস চলার পরই আগুন ধরে ধ্বংস হয়ে যায়। ৫০ বছর বয়সে তিনি তাঁর সিক্রেট চিকেন ফ্রাই রেসিপি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।
১৯৫৫ সালে তাঁর আরও একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তিনি একটি চার রাস্তার মোড়ে রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন। ভালোই চলছিল সেটি। কিন্তু নতুন রাস্তা হওয়ার ফলে সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে রেস্টুরেন্টও বন্ধ করতে হয়। সেই বছর ৬৫ বছর বয়সী কনোনেলের হাতে মাত্র ১৬৫ ডলার ছিল। এরপর তিনি তাঁর চিকেন রেসিপি বিক্রী করার চেষ্টা করেন। ১০০৯টি রেস্টুরেন্ট তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার পর একটি রেস্টুরেন্ট তাঁর রেসিপি নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন বিশ্ব বিখ্যাত খাবারের ব্র্যান্ডের মালিক। এছাড়াও আপনি যদি আপনার এলাকায় কেএফসির একটি শাখা খুলতে চান, তবে আপনাকে শুধু তাদের ফ্রেঞ্চাইজি ব্যবহারের জন্য ৪৫ হাজার ডলার বা প্রায় ৩৮ লাখ টাকা দিতে হবে।
০৭. হেনরি ফোর্ড
১৮৬৩ সালে আমেরিকার মিশিগানে জন্ম নেয়া হেনরি ফোর্ড হলেন বিশ্ব বিখ্যাত গাড়ির কোম্পানী ফোর্ড মোটরস এর প্রতিষ্ঠাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে লাভজনক গাড়ি নির্মান প্রতিষ্ঠানের একটি। বেঁচে থাকতেই হেনরি ফোর্ড তাঁর কোম্পানীকে সফল করে গেছেন এবং নিজেও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী এবং সফল মানুষদের একজন হয়েছেন। যদিও তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তাদের একজন ধরা হয় তবুও প্রথম দিকে তিনি আসলে একজন ব্যর্থ মানুষ ছিলেন। সত্যি কথা বলতে, ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি অন্যের চাকরি করেছেন। ১৮৯৮ সালে তিনি একটি স্বয়ংক্রিয় গাড়ির ইঞ্জিন বানিয়ে সবাইকে দেখান এবং উইলিয়াম এইচ. মার্ফি নামে একজন ধনী ব্যক্তির বিনিয়োগ পান। পরের বছর ফোর্ড তাঁর প্রথম গাড়ির কোম্পানী “ডিট্রয়েড অটোমোবাইল কোম্পানী” প্রতিষ্ঠা করেন (ফোর্ড মোটরস নয়)।
১৯০১ সালে কোম্পানীটি ব্যর্থ হয়। লোনের টাকা শোধ করতে না পারা এবং গাড়ির ডিজাইনে ঝামেলা থাকায় প্রজেক্টটি সফল হয়নি। অবশেষে ১৯০৩ সালে ৪০ বছর বয়সী ফোর্ড তাঁর নিজের নামে কোম্পানী শুরু করেন। এবার তিনি নতুন বিনিয়োগকারী স্কটিশ কয়লা ব্যবসায়ী ম্যালকমসনকে রাজি করান যে সে ব্যবসায়ে নাক গলাবে না। শুধু তার লাভের টাকা বুঝে নেবে। এরপর ফোর্ড তাঁর নিজের মত কাজ করতে শুরু করেন এবং বাকিটা তো শুধুই সাফল্যের গাঁথার গল্প।
০৮. টমাস আলভা এডিসন
বৈদ্যুতিক বাতি, চলচ্চিত্র, অডিও রেকর্ডিং, এনক্রিপটেড টেলিগ্রাফ সিস্টেম, আধুনিক ব্যাটারী – এধরনের হাজারের ওপর আবিষ্কার করে যিনি পৃথিবীকে ঋণী করে গেছেন তিনি আর কেউ নন টমাস আলভা এডিসন ।
১৮৪৭ সালে আমেরিকার ওহাইওতে জন্ম নেয়া এই জিনিয়াসের ছোটবেলায় ‘স্কারলেট ফিভার’ নামে একটি জটিল অসুখ হয়, যার ফলে তিনি কানে প্রায় শুনতেনই না। তাঁর স্কুল জীবন ছিল মাত্র ১২ সপ্তাহের। কারণ তাঁর পড়াশুনার পারফরমেন্স এতই খারাপ ছিল যে স্কুলে আর তাঁকে রাখতে চাইছিল না। স্কুল থেকে দেয়া চিঠিতে লেখা ছিল যে টমাস পড়াশুনায় খুবই অমনযোগী ও তার মেধাও ভালো নয়, এই ধরনের দুর্বল ছাত্রকে স্কুলে রাখা যাবে না। কিন্তু টমাসের মা চিঠি খুলে ছেলেকে শুনিয়ে পড়েছিলেন যে, টমাসের মেধা সাধারণ ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি, এত বেশি মেধাবী ছাত্রকে পড়ানোর ক্ষমতা সাধারণ স্কুলের নেই। কাজেই তাকে যেন বাসায় রেখে পড়ানো হয়। মায়ের থেকে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাস থেকেই টমাস পরে জটিল জটিল সব বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে থাকেন। এবং এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই তিনি কোনও কিছুতেই ব্যর্থতাকে মেনে নিতেন না। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সময়ে ১০ হাজার বার তাঁর এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তিনি তবুও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কারণ ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁর মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, কিছুই অসম্ভব নয়।
তার মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পর তিনি চিঠিটি খুঁজে পেয়েছিলেন। ততদিনে টমাস হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও ধনী উদ্যোক্তা। চিঠিটি পড়ে টমাস সব বুঝতে পারেন। পরবর্তীতে নিজের ডায়েরীতে তিনি লেখেন, , “টমাস আলভা এডিসন একজন ছিল এক মেধাহীন শিশু। একজন অসাধারণ মায়ের প্রেরণায় সে হয়ে উঠে যুগের সেরা মেধাবী।”
০৯. উইনস্টন চার্চিল
উইনস্টন চার্চিলে বৃটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের একজন। ১৮৭৪ সালে জন্ম নেয়া চার্চিল ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ব্যর্থতা ও সাফল্য নিয়ে তাঁর অনেকগুলো বানী পৃথিবীর সেরা বানীগুলোর মধ্যে জায়গা পেয়েছে।
ব্যর্থতা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “ব্যর্থতা মানেই সব শেষ নয়; ব্যর্থতার পরও এগিয়ে যাওয়ার সাহস রাখতে হবে” বা “সাফল্য মানে উৎসাহ না হারিয়ে এক ব্যর্থতা থেকে আরেক ব্যর্থতায় যাওয়ার যাত্রা” – এগুলো সকলের কাছেই পরিচিত। কেননা এই সফল মানুষটির জীবনের অনেকটা জুড়েই আছে ব্যর্থতার গল্প।
রয়্যাল মিলিটারি কলেজে দুইবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তিনি ফেল করেন। ৩য় বার যখন সুযোগ পান, তখন তাঁকে অনেক নিচের একটি ডিভিশন বেছে নিতে হয়েছিল। যদিও তারপর তিনি নিজের চেষ্টা দিয়ে অনেক ওপরে ওঠেন।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ৫টি নির্বাচনে হারেন বৃটেনের ইতিহাসের অন্যতম এই রাজনীতিবিদ।
জানলে অবাক হবেন, ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই বক্তার কথা বলতেই সমস্যা হত। বহুদিন তিনি ডিপ্রেশনে ভুগেছেন। ভাষণ দেয়ার পর সমস্যা হওয়ার কারণে, তাঁর জন্য বিশেষ ওষুধও বানাতে হয়েছিল। কিন্তু এর কিছুই তাঁর চেষ্টা করা থামাতে পারেনি।
১০. জে কে রাওলিং
শুধুমাত্র বই লিখে তাঁর মত ধনী কেউ হতে পারেনি। পৃথিবীর লেখকদের মধ্যে একমাত্র জে কে রাওলিং বই লিখে বিলিওনেয়ার হতে পেরেছেন। তাঁর লেখা হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বুক সিরিজ। আর এই সিরিজ থেকে বানানো সিনেমাগুলো প্রতিটিই ব্লকবাস্টার হিট। জনপ্রিয়তা ও আর্থিক দিক থেকে নি:সন্দেহে তিনি ইতিহাসের অন্যতম সফল সাহিত্যিক। কিন্তু আপনি কি জানেন, কত সংগ্রামের পর হ্যারি পটার প্রকাশ হয়েছিল?
পড়াশুনায় তিনি খুব একটা ভালো ছিলেন না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে টেস্ট দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এক্সিটর ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করেন। পড়াশোনা শেষ করে কোন কাজ না পেয়ে তিনি পর্তুগালে চলে যান এবং সেখানে এক লোককে বিয়ে করেন যে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করত। ১৯৯৩ সালে ৩৮ বছর বয়সে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং বোনের সাথে থাকতে শুরু করেন। এই সময়টাতে তিনি হিসেব করে দেখলেন যে তিনি জীবনের সবকিছুতেই চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি একজন ডিপ্রেশনের রোগীতে পরিনত হন এবং আত্মহত্যারও চিন্তা করেন। কিন্তু মেয়ের কথা চিন্তা করে তিনি আবার আশায় বুক বাঁধেন এবং নিজের লেখালেখির প্রতিভাকে ঘষামাজা করতে করতে হ্যারি পটারের বইটি লিখতে থাকেন। এভাবেই কেটে যায় দু’টি বছর। ১৯৯৫ সালে একটু একটু করে হ্যারি পটারের প্রথম বইটি লেখা শেষ করেন। বইটি লেখার উদ্দেশ্যই ছিল লেখার মাধ্যমে নিজের জীবনের মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করা। রাওলিং তখন একমাত্র মেয়েকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই বইটিও ১৪টি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়।
অবশেষে ১৯৯৬ সালে ব্লুমসবারি নামের ছোট একটি প্রকাশনা সংস্থা বইটি প্রকাশ করার জন্য রাজি হয়। ১৯৯৭ সালে হ্যারি পটারের প্রথম বইটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে পুরো বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায়। রাওলিং অবাক হয়ে দেখেন, এত ব্যর্থতার পরও চেষ্টা করে যাওয়ার সুফল তিনি পেয়েছেন। একে একে আরও বই বের হতে থাকে, সেই সাথে বের হতে থাকে একের পর এক সুপারহিট সিনেমা। ২০০৪ সালে রাওলিং পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে শুধুমাত্র বই লিখে বিলিয়ন ডলারের মালিক হন।
আজ এই ১০ জন সফল মানুষের ব্যর্থতার গল্প বলার উদ্দেশ্য হল ব্যর্থতার পর একজনকে উঠে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়া। সবার মধ্যেই একজন টমাস এডিসন, জে কে রাওলিং আছে। শুধু প্রয়োজন ব্যর্থতা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবার চেষ্টা করার মানসিকতা।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখিকা
ফারিহা আলিফ
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE