প্রয়োজনের তাগিদে পেশার সৃষ্টি আবার প্রয়োজনের খাতিরেই তার বিলুপ্তি অতীতের অনেক জনপ্রিয় পেশাই এখন বিলুপ্তপ্রায় অনেক পেশা ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার জন্য ইতিমধ্যে অনেক জনপ্রিয় পেশাই বিলুপ্তির শঙ্কায় আছে চলুন দেখে নিই প্রযুক্তির উন্নয়ন, শিল্প বিপ্লব অন্যান্য বিভিন্ন কারণে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া টি অদ্ভুত পেশার ব্যপারে

১. ইঁদুর ধরা

হ্যামিলনের বংশীবাদকের কথা মনে আছে? ইঁদুরের উৎপাতে যখন শহরবাসী অতিষ্ঠ, তখন তিনি ত্রাণকর্তারূপে হাজির হয়েছিলেন ইঁদুর নিধন সত্যিকার অর্থেই তখন পেশা হিসেবে বিবেচিত হতো ইঁদুর জনস্বাস্থ্য, সম্পদ এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এরা বসতবাড়ি ফসলের বেশ ক্ষতি করে থাকে প্লেগ মহামারীর কারণও ছিল ইঁদুর এরা রোগটির বাহক সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য এবং যারা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যে আগ্রহী ছিলেন তাদের জন্য ইঁদুরের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ পেশাদারিত্বের সাথে ইঁদুর নিধনের কাজটি করতেন ইঁদুর নিধকেরা তারা ইঁদুরের জনসংখ্যা হ্রাস এবং  নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ ছিলেন

 

ইঁদুর ধরার জন্য সাধারণত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হতো না তবে ইঁদুরের আচরণ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের পাশাপাশি, ফাঁদ এবং ইঁদুর  নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরী ছিলো ইঁদুর ধরার জন্য তারা নোংরা, স্যাঁতসেঁতে জায়গা নির্বাচন করতেন ফাঁদ পাতা পরিচালনার জন্য অবশ্যই শারীরিক শক্তি দক্ষতার প্রয়োজন ছিল তারা বিভিন্ন ধরণের ফাঁদের পাশাপাশি বিষ এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও ব্যবহার করতেন ইঁদুর নিধনের কাজ শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অপ্রীতিকর তবে  বর্তমানে পরিকল্পিত নগরায়ন ইঁদুরনাশক বিভিন্ন  দ্রব্য যন্ত্রপাতি সহজলভ্য হওয়ায় পেশাদার ইঁদুর নিধকদের আর দরকার পরে না তাই এই পেশা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়েছে

.ঘুম ভাঙানো

পেশাটির নামনকারআপ (Knocker-up)’ ক্লায়েন্টদের সময়মতো জাগিয়ে  দেয়াই ছিল তাদের কাজ। ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডে এটি শিল্প বিপ্লবের সময় শুরু হয়েছিল এবং বেশ স্থায়ী হয়েছিল মূলত অ্যালার্ম  ঘড়ি ব্যয়বহুল ছিল তাদের কাজ ছিল নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ঘুমন্ত লোকদের জাগিয়ে তোলা। যাতে তারা সময়মতো কাজ করতে যেতে পারে সময়মতো জাগিয়ে দেয়ার জন্য ক্লায়েন্টের বাড়ির দরজাজানালায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে জাগিয়ে দেয়াই ছিল তাদের পেশা! এবং এর বিনিময়ে তারা অর্থ উপার্জন করত

 

তারা জোরে আওয়াজ করে মানুষকে জাগিয়ে তুলতো কিন্তু মাঝেমাঝে প্রতিবেশীরাও জেগে যেত ক্লায়েন্টদের দরজায় ধাক্কা দেওয়ার জন্য একটি বাঁশের লাঠি ব্যবহার করা হত  অনেক সময় মটর শুটারও ব্যবহার করতেন ক্লায়েন্ট জাগ্রত হয়েছে কি না তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নকারআপ ক্লায়েন্টের জানালা ছেড়ে যেতেন না বর্তমানে এলার্ম ঘড়ির বদৌলতে নকারআপরা শুধুই ইতিহাসের পাতায় বর্তমান

 

. পুনরুত্থানবাদী

১৮১৯ শতকে এমন এক পেশার অস্তিত্ব ছিলো যারা চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানবদেহের ব্যবচ্ছেদ এবং গবেষণার জন্য কবরস্থিত মৃতদেহের পুনরুদ্ধারের মতো অবৈধ ব্যবসায় জড়িত ছিলো এটি এমন একটি সময় ছিল যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা এবং শিক্ষার জন্য মৃতদেহের প্রচুর চাহিদা ছিল। কিন্তু সরবরাহ সীমিত ছিল সেকালে মৃতদেহের চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে কিছু চিকিৎসক সহ অনেক ব্যক্তি তাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি পেতে এই অবৈধ বাণিজ্যের আশ্রয় নিতেন।

পুনরুত্থানবাদীরা কবরস্থান থেকে মৃতদেহ বের করে মেডিকেল স্কুল, অ্যানাটমি শিক্ষক এবং ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে থাকত বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অবৈধ অনুশীলন এটি সমাধির পবিত্রতা লঙ্ঘন এবং মৃত ব্যক্তি তার পরিবারের অধিকারকেও লঙ্ঘন করে পাশাপাশি মৃতদের অধিকার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে একই সাথে গবেষণা শিক্ষায় নীতিনৈতিকতার অনুশীলনের পরিপন্থীসেজন্য পুনরুত্থানের কাজ কখনোই একটি সম্মানিত পেশা হিসেবে স্বীকৃত  ছিলো না

 যারা এই ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা অপরাধী হিসাবেই বিবেচিত  তাদের জন্য কঠোর শাস্তিরও বিধান ছিলো আজও পুনরুত্থানের অনুশীলন বেশিরভাগ দেশেই অবৈধ এবং নৈতিকতার দিক থেকে এটিকে ব্যাপক নিন্দা করা হয় গবেষণা শিক্ষার জন্য মৃতদেহকে এখন অবশ্য নিয়ন্ত্রিত এবং নৈতিক উপায়ে সংগ্রহ করা হয় এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকেই অনুদানের মাধ্যমে সেসব সংগ্রহ করা হয়, যারা স্বেচ্ছায়, মৃত্যুর পরে তাদের দেহটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহারের জন্য সম্মতি জানিয়ে গেছেন

 

.সুইচবোর্ড অপারেটর

স্বয়ংক্রিয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ তৈরি হওয়ার আগে, সুইচবোর্ড অপারেটররা একটি বড় সুইচবোর্ডে উপযুক্ত জ্যাকের সাথে কর্ডগুলি প্লাগ করে ফোন কলগুলোকে ম্যানুয়ালি সংযুক্ত করে থাকতেন তারা এভাবেই সার্বিক পরিষেবা প্রদান করতেন  টেলিফোনের ব্যাপক ব্যবহার স্বয়ংক্রিয়করণের আগে, সুইচবোর্ড অপারেটররা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ফোন কল সংযোগের দায়িত্বেই থাকতেন। 

সুইচবোর্ড অপারেটররা মূলত টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসে কাজ করতেন তারা ম্যানুয়ালি একটি সুইচবোর্ডে তারের প্লাগিং এবং আনপ্লাগ করে কলগুলিকে সংযুক্ত ও বিচ্ছেদ করে থাকতেন পাশাপাশি কলকারীদের তথ্য এবং সহায়তা প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন তারা যেমন : ডিরেক্টরি তালিকা এবং জরুরী পরিষেবা সুইচবোর্ড অপারেটররা প্রায়শই মহিলা ছিলেন কারণ চাকরিটিকে উচ্চ স্তরের ধৈর্য, ​​বিশদ মনোযোগ এবং যোগাযোগ দক্ষতার প্রয়োজন ছিলোবর্তমানে প্রযুক্তির উন্নয়নে তাদের আর দরকার হয় না

. ল্যাম্পলাইটার

বৈদ্যুতিক আলোর ব্যাপক ব্যবহারের আগে, ল্যাম্পলাইটাররা রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বালানো এবং নিভানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন তখন রাতে রাস্তায় আলো জ্বালানোর জন্য গ্যাসের বাতি ব্যবহার করা হতো প্রতিদিন এই বাতিগুলি জ্বালানো এবং নিভানোর পাশাপাশি গ্যাস লাইন সংযোগ এবং বাতিগুলিকে ব্যবহারযোগ্য রাখাও তাদের দায়িত্ব ছিলোতারা প্রতিরাতে একেকটি করে বাতি জ্বালিয়ে ভোরে আবার সেসব নিভিয়ে দিতেন

 

চাকরিটি শারীরিকভাবে কষ্টকর ছিল এবং প্রতিদিন দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটতে হতো ল্যাম্পলাইটারদের সময়ানুবর্তী এবং নির্ভরযোগ্য হতে হতো, কারণ রাতে রাস্তাগুলো যেন ভালভাবে আলোকিত হয় তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি ছিলো ১৯ শতকের শেষের দিকে বৈদ্যুতিক স্ট্রিটলাইট আবিষ্কারের সাথে সাথে ল্যাম্পলাইটারের পেশাটি অদরকারী হয়ে পড়ে বৈদ্যুতিক আলোর আবির্ভাব এবং গ্যাস ল্যাম্পের পতনের সাথে সাথে ল্যাম্পলাইটার তাদের সহকারীর প্রয়োজনীয়তাও দ্রুত হ্রাস পায় এবং পেশাটি পরবর্তীতে অদৃশ্য হয়ে যায়

 

এই বিলুপ্তির তালিকায় এমন অনেক পেশা আছে যেসবের নাম শুনেই ভ্রু কুঁচকে যাওয়া স্বাভাবিক পরিবর্তনের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই তা বিলীন হয়ে যাবে  বাস্তবতার ভিত্তিতে নতুন জিনিসকে স্বাগত জানাতে হবে, এটাই নিয়ম আমাদের সবাইকে পেশা পছন্দের ব্যাপারে আরেকটু যত্নবান হতে হবে কারণ আজকের জনপ্রিয় পেশা, কাল বিলুপ্তির শিকার হলেও হতে পারে !

 

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

 

লেখক, 

মোঃ রাকিব রায়হান 

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট