মার্শাল আর্টের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন কিংবা বলা যায় কিংবদন্তী ব্রুস লি যিনি একজন চীনা মার্শাল আর্ট শিল্পী, তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও অনেকেই মার্শাল আর্ট দেখে থাকবেন।
এই মার্শাল আর্টের মাধ্যমে নিজের সেরাটা দিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত “Vatara Taekwon-Do Association” মাধ্যমে নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন জহুরা আক্তার মিম। আজকে সেই জাতীয় মার্শাল আর্ট খেলোয়াড় জহুরা আক্তার মিম, YSSE এর সৌজন্য সাক্ষাৎকারে আমাদের সাথে যুক্ত আছেন। আজ আমরা তার সম্পর্কে ও তার কাজের ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো।
YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার পরিচয়, বেড়ে উঠা, পড়াশোনা ও বর্তমানে কী করছেন?
আমি জহুরা আক্তার মিম। আমার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। আমার জন্মগ্রহণ ঢাকায় এবং এখানেই বেড়ে ওঠা। এখন পড়াশোনা করছি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি), কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষে। আমার কলেজ ছিলো বিসিআইসি কলেজ। এছাড়াও আমি আইইউবিএটি তে মার্শাল আর্ট ইনসট্রাক্টর হিসেবে আছি।
YSSE: আপনার প্রতিষ্ঠিত Martial Arts School- “Vatara Taekwon-Do Association” সম্পর্কে কিছু বলুন। এর পিছনের গল্পটা সম্পর্কে জানতে চাইছি।
আসলে এই পৃথিবীতে আমরা দেখতে পাই মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে হেনস্তার শিকার হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেয়েদের সুরক্ষার কমতি আছে বলে আমি মনে করি। এমনকি আমি নিজেও অনেকবার হেনস্তার সম্মুখীন হয়েছি। সেই সময়টাতে আমি অনেক ইন্ট্রোভার্ট টাইপের ছিলাম। অন্য কারো সাথে রেসপন্স করতে পারতাম না, শুধুমাত্র আমার পরিবারের সাথে কথা বলতাম। সেই সময়টাতে আমার নিজেকে মেয়ে হিসেবে ছোট মনে হয়। আমি বাইরে চলাফেরা করতে গেলেও নিরাপদ অনুভব করতে পারিনা। তখন আমার মনে হয়েছে আমি মার্শাল আর্ট শিখবো এবং যখন আমি এটা শেখা শেষ করলাম আমার আত্নবিশ্বাস ছিলো আমি আমার এই শেখার পর্যায়টা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে পারবো। আমি এই ব্যাপারে ফেডারেশনের হেড এর সাথে কথা বলি। স্যারকে বললাম, আমি নিজেই শিখেছি পুরুষ প্রশিক্ষকের মাধ্যমে, তো স্যার ভালোভাবে দেখাতে পারতোনা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে স্পর্শের ব্যাপারের কারণে। একারণে দেখা যেতো আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগতো। তাই অনেক মেয়েরাই পুরুষ প্রশিক্ষকের কাছে অস্বস্তিকর অনুভব করে। এজন্যই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম একজন মেয়ে হিসেবে আমি শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করবো। তখন স্যার অনুমতি দিলেন।
এরপর আামার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। আমি মাত্র চারজন মেয়ে নিয়ে মার্শাল আর্ট একাডেমি শুরু করি। আমি ৪টি শাখাতে মার্শাল আর্ট শিখাই, মিরপুর, ভাটারা, উত্তরা, আগারগাঁও। আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমার একাডেমি অনেক ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হলো মেয়েদেরকে আত্নবিশ্বাসী করা এবং রাস্তায় হেনস্তার শিকার, বুলিং, অপমানজনক কথা দিয়ে আঘাত করা, গায়ে হাত দেয়া, শারীরিকভাবে অপদস্ত কিংবা বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে শিখা।
YSSE: আপনার এই দীর্ঘ জার্নিতে সফলতা বা বিশেষ ভালোলাগার দু‘একটি মূহুর্ত আমাদের সাথে যদি শেয়ার করতেন?
আমি আমার শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষণীয় জায়গায় ঘুরতে যাই এবং সেখানে প্র্যাকটিস সেশন রাখি। ফলে তারা শুধু মার্শাল আর্ট নয় অন্যান্য ব্যাপারগুলোও উপভোগ করতে পারবে। সেদিন যখন ভোরে ওদেরকে বোট্যানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে গেলাম, কিছু অভিভাবক দেখলো যে এখানে সবাই মেয়ে। তারা যখন জানতে পারলো যে আমি শিখাই, দুই’জন অভিভাবক আমাকে বলেন যে তাদের মেয়েকেও শিখাতে চান। তারা পুরুষ প্রশিক্ষকের কারণে কোথাও দেয়নি। এইযে আমার একাডেমি থেকে তারা একটা ভরসার জায়গা খুজে পেয়েছে। আমাদের প্রত্যেকটা স্টাফ মেয়ে। এখানে নিরাপত্তা নিয়েও ভয় পেতে হবেনা। অনেক জায়গায় মেয়েরা হেনস্তার শিকার হয়। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় এটা আমার একাডেমির একটি পজিটিভ দিক। মেয়েরা আত্মরক্ষার কৌশল, আত্নকেন্দ্রীক হওয়া, পাবলিক স্পিকিং এই জিনিসগুলো অবশ্যই পজিটিভ দিক।
YSSE: আপনি কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন?
যেহেতু সেনসিটিভ পরিবার তাই আব্বু কোথাও যেতে দিতোনা। আব্বু জানতো যে আমি ইউনিভার্সিটি দিক থেকে আমি মার্শাল আর্ট শিখছি যাতে আব্বু রাজি হয়। আসলে এটা ইউনিভার্সিটি কোনো দিক ছিলোনা আমি আলাদাভাবে যুক্ত হয়েছিলাম। এইযে খরচের ব্যাপারটা উনিফর্ম, ব্লাক বেল্ট এগুলো আম্মু দিতো। তখন এটা মাসে যে ফি দিতে হয় সেটা ফ্রী ছিলো। শীতের সময় আমি ট্রেনিং এ গেছি, আব্বু জানতো না, আম্মু কম্বলের নিচে বালিশ দিয়ে রাখতো। পরবর্তীতে আব্বু আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। এখন প্রায় সব টুর্নামেন্টে যখন আমি প্রাইজ নিই আমার ফটোগ্রাফার আব্বু হয়। কোথাও যেতে চাইলে আব্বু আমাকে দিয়ে আসে। বিয়ের পরে আমার স্বামী আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। কাজাকিস্তানে যাওয়ার সময়, যখন বিশ্ব চ্যাম্পীয়নশীপ হয় তখন নিশ্চয়তা ছিলোনা একা যেতে দিবে কিনা। এটা নিয়ে আমি আপসেট ছিলাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে সিলেক্ট হয়েছি কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পীয়নশীপে যেতে পারবোনা। তবে এই প্রতিবন্ধকতাও আমি কাটিয়ে উঠেছি এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নে বাংলাদেশের পতাকা উড়াই।
YSSE: আপনার অনুপ্রেরণা কারা বা কী ছিল?
ছোটবেলায় আব্বু বলতো নায়ক রুবেল চলচ্চিত্রে যে মুভমেন্ট করতো, সেগুলো তিনি নিজে করতেন। আমি যখন ওনাকে একটি চলচিত্রে উনিফর্ম পড়া দেখি তা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। আমার আব্বু জাহাঙ্গীর আলম স্যারের কাছে জুডো শিখতো। আব্বু আমাকে বলতো তোমাকে অনেক কিছু শিখাবো। কিন্তু আমার পরিবার সেনসিটিভ ছিলো তাই মেয়ে হিসেবে বাইরে যেতে দিতে সাহস করেনি। আমার বান্ধবীরা বাসায় এসে আড্ডা দিতো। কিন্তু যখন ইউনিভার্সিটি তে উঠলাম, লিংকআপ পাই এবং মার্শাল আর্টে যুক্ত হই। এছাড়াও আমার আব্বু, আম্মু সাহায্য করেছে, অনুপ্রেরণা দিয়েছে ।
YSSE: আপনার সফলতার পেছনে কাদের সাপোর্ট এর কথা আপনি উল্লেখ করতে চান?
আমার আব্বু – আম্মু, এছাড়াও আমার বন্ধুরা আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে এবং স্ট্রাগলও করেছে। বিয়ের পরে অনেকে অনেক স্বপ্ন ছেড়ে দেয়, সেক্ষেত্রে আমার পরিবার, আমার স্বামী আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। আশেপাশের সবাই সাপোর্ট করেছে।
সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমাদের অতিথির বাকি গল্প সম্পর্কে জানতে পারবেন। এবং আরো কিছু প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে অতিথির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এবং তার কাজ জানতে পারবেন। পরবর্তী পর্ব মিস করবেন না।
ধন্যবাদ সবাইকে।
ফেসবুক: https://www.facebook.com/mithilamimi.3190?mibextid=ZbWKwL
ফেসবুকপেজ: https://www.facebook.com/profile.php?id=100071914804769&mibextid=ZbWKwL
লেখক :
তৌহিদা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
Youth School for Social Entrepreneurs (YSSE)