সদ্য যৌবনে পা রাখা সিদ্ধার্থ তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান,আধুনিক জীবনের সাথে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে পরিচালক তৈরি করেছিলেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০)। 

 

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ৬০ এর দশকের সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির শহর কলকাতায় অস্থির সময়ের ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি। সিনেমাটি যে সময়কালে করা হয়েছে,যখন নকশাল (মাওবাদী) আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক অসহায় উদ্বাস্তুদের আগমনের কারণে শহরটি অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। শিক্ষিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণদের জন্য এটি একটা হতাশাজনক সময় ছিল, কারণ তরুণদের একাংশ ছিল বেকারত্ব সমস্যায় জর্জরিত। সিনেমাটির প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থ (ধৃতিমান চ্যাটার্জি) তার বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে ডাক্তারি পড়া বন্ধ করে দেয়। আর্থিক অবনতির কারণে পরিস্থিতি তাকে কর্ম জীবনে আসতে বাধ্য করে। সে তার মা, ছোট বোন এবং ভাইয়ের সাথে একটি ছোট  ফ্ল্যাটে থাকে।ভাঁজ করা জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে,লোকাল বাসে উঠে ইন্টারভিউয়ের জন্য রওনা দেয়।

 

সিনেমার প্রথম অংশে দেখানো চাকরির একটি ইন্টারভিউতে সিদ্ধার্থ কঠোর চেহারার আমলাদের কাছে অকপটে স্বীকার করেন যে, তিনি মনে করেন,  যুদ্ধে সাধারণ ভিয়েতনামের লোকেরা যে “অসাধারণ মানব সাহস” দেখিয়েছিল তা আমেরিকানদের চাঁদে অবতরণের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই স্বীকারোক্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এটি কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বা কোনো ধরনের নৈতিক বিজয় অর্জনের ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা নয়। এটা সিদ্ধার্থের ব্যক্তিগত মতামতের মনস্তাত্ত্বিক স্বীকারোক্তি। এটি একটি উন্মুক্ত, চিন্তাশীল মনের ফসল – যেখানে বাকি বিশ্ব মতাদর্শগত ধর্মান্ধতা দেখে, সিদ্ধার্থ প্রকৃত মানুষের সাহসিকতাকে স্বীকৃতি দেয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা তাকে একজন কমিউনিস্ট হিসেবে দাবী করে প্রশ্নবিদ্ধ করেএবং সিদ্ধার্থ পাল্টা জবাব দেয়, ভিয়েতনামের প্রশংসা করার জন্য তাকে একজন কমিউনিস্ট হতে হবে।পরবর্তীতে সিদ্ধার্থ অনুপযুক্ত জবাব দেওয়ার কারণে আপসোস করতে থাকে। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় চাকরি পেতে নিজের বিশ্বাসের সাথে আপোস করতেও তার কোনো দ্বিধাবোধ নেই।

 

সিদ্ধার্থের চাকরি নেই, অথচ তার ছোট বোন তপু (সুতপা) এর চাকরি আছে। সিদ্ধার্থের ধারণা ছোটবোনের চাকরিপ্রাপ্তির পেছনে তার যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা নয়, বরং রূপসৌন্দর্যই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। একদিন সিদ্ধার্থ বাড়ি ফিরে দেখে  সুতপার বসের স্ত্রী তাদের বাড়িতে এসে অভিযোগ তোলে, “আপনাদের মেয়ে আমার সংসার ধ্বংস করেছে”, তা-ও সে শান্তভাবে মেনে নেয়। এক্ষেত্রে তার সমস্ত রাগ বোনের উপর নয়, বরং বোনের বসের উপরে গিয়ে পড়ে। বসের অর্থবিত্তের বলয় তাকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে।সুতপা যখন মডেলিং করার ইচ্ছা পোষণ করে কিংবা সন্ধ্যায় নাচ শেখে তখন সিদ্ধার্থ এসবে দ্বিরুক্তি করে না। হতাশ মনেমেনে নেয় সব। সিদ্ধার্থ শুধু একটি কথাই বলে , “তুই বদলে গেছিস, তপু।”

 

বসের বাড়ি থেকে ফেরার পথে গাড়িচাপা দেওয়ার অপরাধে একজন ড্রাইভারকে গণপিটুনি দিতে দেখে। তখন তার সেই রাগ (বোনের বসকে মারতে না পারার ক্ষোভ) পুনঃজাগ্রত হয়। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সে নিরীহ ড্রাইভারকে গণপিটুনি দেওয়ায় যোগ দেয়। কিন্তু মুহূর্তেই তার ভ্রান্তি দূর হয়,।তৎক্ষণাৎ সে পিছিয়ে আসে। গাড়িতে বসা একটি স্কুলগামী মেয়ের ভীত এবং আতঙ্কিত মুখ তাকে পীড়া দেয়।সিদ্ধার্থের বন্ধু শিবেন সিদ্ধার্থকে একটি পতিতালয়ে নিয়ে যায় যাতে সে তার জীবনের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে পারে। সিদ্ধার্থ ঘৃণিত অনুভব করে সাথে সাথে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। মধ্যরাতে অন্ধকার রাস্তায় হাঁটার সময়, তিনি শুনতে পান একজন নারী তাকে সাহায্যের জন্য ডাকছে। সে তার ঘরে ঢুকে ফিউজ ঠিক করে। এভাবেই সিদ্ধার্থের সাথে  কেয়া মুখার্জির সাথে পরিচয় ঘটে।

 

পরের দিন সিদ্ধার্থ আরেকটি চাকরির ইন্টারভিউয়ে উপস্থিত হয়। যেখান সমস্ত সাক্ষাত্কার এক ছোট্ট জায়গায় অজস্র চাকরিপ্রার্থীকে ডেকে সবার জন্য বসার জায়গা না রাখার অব্যবস্থাপনা, একজন প্রার্থীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং এরই মাঝে প্রশ্নকর্তাদের লাঞ্চের বিরতি নেওয়ার ঘটনায় সময়  প্রতিবাদ জানাতে উদ্বুদ্ধ করে। সে ভাংচুর করে জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসে। উগ্র সিদ্ধার্থ অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাদের সাথে মূল্যহীন পশুর মতো আচরণ করার জন্য উত্তর দাবি করে।

 

সিদ্ধার্থ বালুরঘাট শহরে এসে কেয়াকে চিঠি দেয়। সে চিঠিতে লিখে বর্তমান নিম্ন-শ্রেণীর হোটেল রুম থেকে স্থানান্তরিত হওয়ায় তিনি তার নতুন বাড়ির ঠিকানা পাঠাবেন। তারপর সে তার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে আসে যেখানে একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে। মৃতদেহ বহনকারী লোকেরা “রাম নাম সত্য হ্যায়” স্লোগান দিচ্ছে। তারপরে চলচ্চিত্রটি এখানে শেষ হয়, প্রতীকীভাবে সিদ্ধার্থকে জীবনের চিরন্তন সত্যের সন্ধান করে।

 

‘প্রতিদ্বন্দ্বী জীবন নিয়ে সিনেমা । হতাশ, মেধাবী, কিন্তু কর্মহীন যুবকের জীবনের কাহিনি । চাকরি, সামাজিক অবস্থান এবং মানসিক প্রশান্তি যে একে অপরের সাথে সংযুক্ত তা পরিস্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে এখানে। সত্যজিৎ রায়ের  চিত্রিত ফিল্মোগ্রাফির উপর সবচেয়ে প্রভাবশালী সিনেমাগুলির মধ্যে একটি হল প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৭১ সালে এই চলচ্চিত্রটি ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক’ এর পুরস্কারসহ মোট তিনটি ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ অর্জন করেছিল।  সত্যজিৎ রায় দৃশ্যবর্ণনায় ক্লোজ-আপ ব্যবহার করেন যা অত্যন্ত তীব্র,সুক্ষ্ম  এবং কার্যকর। সিনেমায় দেখানো আধুনিক জীবনের অস্থিরতা এবং জটিলতার বাস্তব প্রতিফলন আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। 

 

এরকম আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন

নুপুর আক্তার 

ইন্টার্ন

কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE