নব্বই দশকের দিকে প্রাণ পটেটো ক্র্যাকার্স কিংবা প্রাণ ললিপপ টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে খাওয়া হয়নি এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। সময়ের বিবর্তনে ‘প্রাণ প্রোডাক্টস’ শব্দটা এতটাই পরিচিতি লাভ করেছে যে, নিত্য ব্যবহার্য জিনিষে ‘প্রাণ’ এখন অনিবার্য বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কিভাবে একজন ব্যক্তির পেনশনের সামান্য অর্থ থেকে একশো কোটি টাকায় এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলো।
শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক প্রাণ কোম্পানির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে।
প্রাণ বর্তমানে দারিদ্রতা এবং ক্ষুধার্ততা নিয়ে কাজ করছে, যা বর্তমানে পৃথিবী ব্যাপী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা সকলেই জানি যে, জাতিসংঘের ২০১৫ সালে নেয়া উদ্যোগ SDG এর ১৭টি লক্ষ্যের প্রথম লক্ষ্যই হল দারিদ্রতা নিরসন করা। প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পূর্ণরূপ আমাদের বেশিরভাগেরই অজানা। PRAN-এর পূর্ণরূপ “Programmed for Rural Advancement Nationally” বাংলায় এর পূর্নরূপ “প্রগতি রূপায়ণ অগ্রণী নবোদ্যম”। RFL-এর পূর্ণরূপ “Rangpur Foundry Limited”।
প্রাণ কোম্পানির পথচলা শুরু হয় রংপুরে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরীর হাত ধরেই। দীর্ঘ ২৫ বছর সেনাবাহিনীতে চাকরী করে অবসরে গিয়েও তিনি স্থির থাকতে পারেননি। ১৯৮১ সালের দিকে তাঁরই হাত ধরে সূচনা এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটির।
প্রথমেই আমজাদ খান চৌধুরী তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পৈতৃক সম্পত্তির কিছু কাগজ নিয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে কিছু অর্থ নিলেন এবং তার সাথে যোগ করলেন নিজের পেনশনের টাকা। অনেকের ধারণা থাকে ব্যবসার শুরুতে বড় ধরণের বিনিয়োগের উপর ব্যবসার প্রসার নির্ভর করে। এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে আমজাদ খান চৌধুরী স্বল্প অর্থের বিনিয়োগে শুরু করা ব্যবসাকে আজ বিশাল অর্থের এক প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে।
আমজাদ খান চৌধুরীর মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ যেসকল দরিদ্র কৃষক আছে তাদের স্বার্থে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা। তাই তিনি প্রথম মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত আর এফ এল পাম্প। এরপর থেকে এক এক করে খাদ্য, প্লাস্টিক এবং নানা কৃষি পণ্য বাজারে নিয়ে আসেন। বর্তমানে তার এই প্রতিষ্ঠান প্রায় এক হাজারেরও অধিক পণ্য উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে।
প্রাণের ব্যবসা মূলত কৃষিকেন্দ্রিক। এর বড় একটি কারণ আমজাদ খান চৌধুরীর দেশের কৃষি এবং কৃষকদেরকে নিয়ে চিন্তাভাবনা। ভবিষ্যৎ পণ্য হিসেবে ‘প্রাণ’ লবণ, পাউরুটি, ইনস্ট্যান্ট ম্যাকারনি ইত্যাদি পণ্য বাজারে নিয়ে আসারও চিন্তাভাবনা করছে।
প্রাণের পথচলার শুরুর দিক থেকেই তারা বেশ ব্যবসা সফল একটি প্রতিষ্ঠান। তাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের ময়দানে বিচরণ করা তাদের জন্য খুব একটা কঠিন কিছু ছিল না। প্রাণের প্রথম পণ্য রপ্তানির গল্পটাও বেশ অবাক করে দেয়ার মতো।
প্রাণ প্রথম কৌটাজাতকরণ আনারস নিয়ে রওনা হয় জার্মানির উদ্দেশ্যে। তখন মালয়েশিয়া থেকেও প্রচুর আনারস রপ্তানি হতো ইউরোপে। এই আনারসের চাহিদা মেটাতেই ফ্রান্স থেকে শুরু করে গোটা ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশে পোঁছে যায় প্রাণের পণ্য। বর্তমানে প্রাণের পণ্যগুলো প্রায় ১৪৫ টি দেশে বিদেশি কিংবা প্রবাসীদের হাতে হাতে পোঁছে গিয়েছে। আর এভাবেই দেশের ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি মাল্টিন্যাশনাল গ্রুপের অগ্রযাত্রা শুরু।
প্রাণের কর্মসংস্থানের দিকে তাকালে দেখা যাবে বর্তমানে প্রাণ ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয় প্রাণের এই সফলতার পেছনে আছে প্রতিটি কর্মচারীর প্রতি প্রাণের সমান দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে কেও কারও উর্ধ্বে নয়। সকলের পোশাক এবং কাজ করার চিন্তাভাবনা একই। এটি মূলত আমজাদ খান চৌধুরীরই একটি মূলমন্ত্র।
প্রাণ কোম্পানির সফলতার দিক বিবেচনা করলে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল (Business Strategy) বেশ সৃজনশীল এবং তাৎক্ষণিকভাবে পরিবেশের সাথে মোকাবেলা করার মতো। তাদের একটি কৌশল্যার কথা না বললেই নয়, সেটি হল “কাইযেন” বা “Kaizen”। এটি জাপানের একটি ব্যবসায়িক কৌশল যার অর্থ ‘নিরবচ্ছিন্ন উন্নতি সাধন’।
প্রাণ এই কৌশল রপ্ত করে ২০১৭ থেকে তাদের ব্যবসায়ে নিরবচ্চিন্নভাবে উন্নতি সাধন করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রাণে কর্মরত প্রকৌশলীরা মিলে এই কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে হবিগঞ্জের চারটি মেশিনের পুনরায় প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি সুযোগ তৈরি করেন। যাতে করে প্রতিমাসে প্রাণ ২৬,০০০ কেজি আলুর টুকরো পুনরায় প্রক্রিয়াজাত করার সুযোগ পায়। এতে করে শুধুমাত্র প্রাণের ব্যবসায়িক পরিবর্তনের পাশাপাশি তারা মেশিনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের খরচ হ্রাসেও সক্ষম হয়।
আমজাদ খান চৌধুরীর ইন্তেকালের পর তার মেজো ছেলে আহসান খান চৌধুরীর জন্য এখনো প্রাণ একটি সফল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। আহসান খান চৌধুরী তার বাবার দেখানো পথ ধরেই তার শিক্ষা এবং দীক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বেশ মিতব্যয়ী। তার এই মিতব্যায়ীতার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন তার অনেক দায়িত্ব এবং কর্তব্য আছে দেশের প্রতি এবং দেশের প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি। তার এই চিন্তাধারায় প্রাণ বিশ্বের বুকে আরও অনেক সফলতার দেখা পাবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।
এমন আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখক
শিহাব শাহরিয়ার স্পর্শ
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE