আমরা প্রায় প্রতিনিয়তই প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। পানির বোতল থেকে শুরু করে ঘরের আসবাবপত্র হিসেবে প্লাস্টিক বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, আমরা কী জানি পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক এক মারাত্মক হুমকি? বিশেষ করে প্লাস্টিক দূষণ মানবজাতি, বাস্তুতন্ত্র এমনকি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক। আজকের এই পৃথিবীতে প্লাস্টিক দূষণের হার মাত্রাঅতিরিক্ত হারে বেড়ে চলেছে। আর এর কারণসমূহ হিসেবে বলা যায়, যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ফেলা। প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলা।
আমরা জানি সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলাটা সমুদ্রজগতের প্রাণীদের জন্য কতটা ক্ষতিকারক। কারণ সামুদ্রিক প্রাণীরা প্লাস্টিককে তাদের খাদ্য মনে করে গ্রহণ করছে। যার ফলে এটি তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া অতিরিক্ত প্লাস্টিক সামুদ্রিক প্রাণীদের বাসস্থান নষ্ট করে দিচ্ছে যার ফলে এসব প্রাণীরা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি যে শুধু সামুদ্রিক প্রাণী জগতকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে তা নয়, তাছাড়া দেশের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন পানির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে যার ফলে মানবস্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তাছাড়া প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে যে দূষণটি হচ্ছে তাও আমাদের স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর। পোড়ানের ফলে প্লাস্টিক দূষণ বায়ুদূষণের মাত্রাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশের জন্যও হুমকির প্রধান কারণ। এক গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলাফল হিসেবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া, তথ্যমতে, প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ প্লাস্টিকের কারণে হওয়া বায়ুদূষণ।
প্লাস্টিক দূষণের মতো মারাত্মক এই অভিশাপ থেকে বাঁচার উপায় কী? প্লাস্টিক দূষণের কারণ মূলত মানুষই। তো প্লাস্টিক দূষণের প্রতিকারের কথাও মানুষেরই ভাবার বিষয়। আমাদের সম্মিলিত পদক্ষেপই রুখে দিতে পারে প্লাস্টিক দূষণকে। চলুন তাহলে জেনে নিই কিভাবে আমরা প্লাস্টিক দূষণের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারি:
রিডিউস, রিইউস, রিসাইকেল: প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধের প্রথম এবং প্রধান ধাপ হতে পারে প্লাস্টিকের পুনরায় ব্যবহার এবং পুরাতন প্লাস্টিককে নতুন প্লাস্টিকে রূপান্তর। এতে করে নতুন প্লাস্টিক উৎপন্ন হওয়ার শঙ্কা অনেকাংশেই কমে যাবে। যার ফলে প্লাস্টিক দূষণের হারও কমবে। তাছাড়া প্লাস্টিক ব্যবহারে অনিহা বা প্লাস্টিক কম ব্যবহার করে অন্যান্য বিকল্প পণ্য সামগ্রী ব্যবহার করার অনুশীলন প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আমাদেরকে জিরো ওয়েস্ট সলিউশনে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে পলিমার জাতীয় বর্জ্য আমাদের সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং আমাদের জীবনযাত্রার ক্ষতি সাধন না করে।
টেকসই জিনিস ব্যবহার: আমাদের ছোট উদ্দ্যেগ প্লাস্টিক দূষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা যদি প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহার না করে টেকসই জিনিস ব্যবহার করি তাহলে প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে এই পৃথিবী রক্ষা পাবে। এক্ষেত্রে আমরা পলিথিনের বদলে কাপড়ের ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের বোতলের বদলে স্টিলের আসবাবপত্র ব্যবহার করতে পারি। প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে পচনশীল দ্রব্যের ব্যবহার আমাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।
আইন প্রয়োগ: প্লাস্টিক দূষণ কমাতে আইনের প্রয়োগ খুবই জরুরি। সকল দেশে আইন করে প্লাস্টিক এবং পলিথিন জাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার করলে তাদেরকে কঠোর জরিমানার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানাসমূহকে রিসাইকেলের প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলতে হবে। প্রয়োজনে প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানাগুলোকেও নিষিদ্ধ করতে হবে।
সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্লাস্টিক দূষণ আজ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আজ মানুষ তাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক ফেলছে নালা, নর্দমা এবং সমুদ্রে। এসকল প্লাস্টিক গভীর সমুদ্রে মিশে গিয়ে জলজ প্রাণীর অনেক ক্ষতি করছে। সম্প্রতি এক নিউজে দেখা গিয়েছে, একটি তিমি মাছ সমুদ্রের বালুকাবেলায় মৃত পড়ে আছে এবং এর কারণ হিসেবে তার পাকস্থলীতে অসংখ্য পলিমার জাতীয় দ্রব্য পাওয়া গিয়েছে। এই প্লাস্টিক কিন্তু মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে মানবস্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। তাছাড়া এসব প্লাস্টিক নালা এবং নর্দমার পানিকে বাঁধা দিচ্ছে যার ফলে অল্প বৃষ্টিতে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আমাদের নালা, নর্দমা এবং সমুদ্রসমূহ স্বচ্ছ রাখা খুবই প্রয়োজন।
সচেতনতা বৃদ্ধি: প্লাস্টিক দূষণের সবথেকে কার্যকরি পদক্ষেপ হতে পারে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি। কারণ আমরা যদি নিজেরা সচেতন না হয়, প্লাস্টিক দূষণ কোনো ভাবে বন্ধ করা যাবে না। তাই আমাদের যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের জিনিস ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। এক্ষত্রে টেলিভিশন মিডিয়াগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া পাঠ্যবইয়ে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করে তুলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দূষণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে।
প্লাস্টিক দূষণ মারাত্মক এক সমস্যা। যেহেতু প্লাস্টিকের পচন হয় না আবার পোড়ালেও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় সেহেতু এটি কম ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই। প্লাস্টিকের উৎপাদন যদি দিনে দিনে বাড়তে থাকে তাহলে দেখা যাবে এই পৃথিবী একদিন প্লাস্টিক দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে হবে। আমাদের মানুষদেরকে একটু একটু পরিবর্তনের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে হবে। কারণ আমরা নিজেরা যদি সচেতন হয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার না করি তাহলে এই পৃথিবী একদিন প্লাস্টিক দূষণমুক্ত সুন্দর পৃথিবীতে পরিণত হব। তাই এখনই সময় প্লাস্টিক দূষণ রোধের অঙ্গীকার করার।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
প্রত্যয় কান্তি দাশ,
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট,
YSSE