একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাই আমাদের চারপাশে শতশত ডায়বেটিস রোগী যারা ইনসুলিন গ্রহণ করে সুস্থ জীবন-যাপন করছেন।কখনো কি খেয়ালে এসেছে কে এই হাজার লোকের জীবন রক্ষাকারী ইনসুলিন আবিষ্কার করেছেন?চলুন আজকে আমরা ইনসুলিন আবিষ্কারক নোবেল বিজয়ী- ফ্রেডেরিক জি.ব্যান্টিং স্যারকে নিয়ে কিছু জানা-অজানা তথ্য বিশদভাবে জানার চেষ্টা করি।

এই বিশ্বসাড়া ফেলে দেওয়া চিকিৎসকের জন্ম ১৮৯১ সালের ১৪ই নভেম্বর কানাডার অন্টারিওতে একটি খামারে।  শৈশবের দু’টি বিচিত্র ঘটনা তাঁকে চিকিৎসক হতে বেশি ত্বরান্বিত করেছিল। প্রথমটি হল একটি ছাদের পতন যেখানে দুই ব্যক্তি কাজ করছিলেন। ব্যান্টিং দ্রুত শহরের ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলেন,যেটা তাঁর মনে দাগ কেটে রেখেছিলদ্বিতীয়টি ছিলো তার কাছের একজন বন্ধুর মৃত্যু।তাঁর বন্ধু জেন ১৪বছর বয়স পর্যন্ত অত্যন্ত চটপটে,উজ্জ্বল এবং উদ্যমী ছিলেন।কিন্তু তিনি যখনই তাঁর ওজন কমাতে শুরু করলেন তিনি ডায়বেটিস মেলিটাসথেকে মারা যান।এই ঘটনার পর থেকে তিনি সংকল্প করলেন ব্যান্টিং চিকিৎসক হবেন যদিও তাঁর পরিবার সেটার বিরুদ্ধে ছিল।প্রথমে তিনি ধর্মতত্ত্ব কলেজে ভর্তি হন পরে সেখান থেকে পরিবর্তিত হয়ে কানাডার টরন্টোতে ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো মেডিকেল স্কুলে স্থানান্তর করতে সক্ষম হন।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে এবং তিনি কানাডিয়ান আর্মি মেডিকেল কর্পসে যোগ দেন সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে দায়িত্ব পালন করেন।

1919 সালে যুদ্ধ শেষে ব্যান্টিং কানাডায় ফিরে এসেছিলেন এবং অল্প সময়ের জন্য লন্ডন, অন্টারিওতে একজন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। তার পেশাদার যাত্রা অর্থোপেডিক মেডিসিন অধ্যয়নে শুরু হয় এবং 1920 সালে টরন্টোর অসুস্থ শিশুদের জন্য হাসপাতালে আবাসিক সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থোপেডিকসে শিক্ষকতা করেন এবং লগভার্ড মেডয়াল কলেজে ফার্মাকোলজি প্রভাষক হিসেবে কাজ করেন। 1922 সালে স্বর্ণপদক সহ এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

প্রভাষক থাকাকালীন তাঁর একটি বক্তৃতা ছিলো  অগ্ন্যাশয়ের উপর এবং তিনি সতর্কতার সাথে সেটি পর্যালোচনা করছিলেন।পর্যালোচনা করার সময় তিনি দেখতে পান অগ্ন্যাশয় বিভিন্ন রস তৈরী করে অন্ত্রে খাবারকে ভেঙ্গে দিতে সাহায্য করে।তিনি লক্ষ্য করেন অন্য কয়েকজন ডাক্তারের গবেষণায়, প্যানক্রিয়েক্টোমিজড কুকুরগুলিও মানুষের ডায়াবেটিস রোগীদের অনেক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।1900 সালে, ডাঃ ইউজিন লিন্ডসে ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্ন্যাশয় ল্যাঙ্গারহ্যান্সের আইলেটস নামক কোষের গুচ্ছ ছাড়া স্বাভাবিক দেখায় বলে মন্তব্য করেছিলেন।

ডাঃ মোসেস ব্যারনের প্রতিবেদনে বলেন ময়নাতদন্তে এক রোগী তার অগ্ন্যাশয় নালী অগ্ন্যাশয়ের পাথর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, তবে আইলেট কোষগুলি সংরক্ষণ করা হয়েছিল। 1901 সালে, ডাঃ লিওনিড সোবোলিউয়ের পরীক্ষায় দেখা যায় কুকুরের আইলেট কোষগুলি অগ্ন্যাশয় নালীগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কার্যকর ছিল।এই কুকুরে অগ্ন্যাশয়ের পরীক্ষার মাধ্যমেই তিনি তাঁর কাজ শুরু করেন।তিনি টেরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে তার ছাত্র ডাঃ চার্লস হার্বার্ট বেস্টের মাধ্যেমে পরীক্ষা শুরু করেন।প্রথমে তারা কুকুরের আইলেট কোষ বন্ধ করে দেন এবং একটি নির্যাস তৈরি করেন, যা মার্জোরি নামে অসুস্থ কুকুরের ইনজেকশন দেয়। প্রথম দিনেই কুকুরের আচরণে পরিবর্তন হয়, এবং শর্করার মাত্রা কমে যায়। বিপরীতমুখী হওয়ায় ব্যান্টিং তাকে ‘আইসলেটিন’ বলে।যদিও এই সাফল্য খুব সংক্ষিপ্ত সময়জুড়ে ছিলো কারণ রক্তে শর্করার ড্রপ সাময়িক ছিল।তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অগ্ন্যাশয়ের নির্যাসের জন্য একটি বড় উৎসের দরকার।

যেহেতু তাঁর শৈশব কেটেছে খামারে তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন গর্ভবতী গরুর অগ্ন্যাশয় ব্যবহার করলে আরো বেশি কার্যকর হবে।পরীক্ষা-নিরিক্ষা চলতে থাকলে একসময় একজন জৈব রসায়নবিদ ডক্টর জেমস কোলিপের সাহায্যে ব্যান্টিং’র দলটি অবশেষে মানুষের ব্যবহারের জন্য ইনসুলিনকে বিশুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।যার জন্য পরে তিনি ১৯২৩ সালে যৌথভাবে নোবেল পুরুষ্কার লাভ করেন।

এই মানবসেবী চিকিৎসক যিনি হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন একটি ইনসুলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন তার দেশকে,মানব সেবাকে।তিনি ১৯৪১ সালের ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বিমান বিপর্যয়ে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর এই অবদান যুগে যুগে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে পৃথিবীর সকল মানুষ।

 

এরকম আরও  ব্লগ পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

 

লেখক

দীপান্বিতা চাকমা

ইন্টার্ন,

কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট,

YSSE.