দুপুর ২ টায় বাস ছাড়ল। গন্তব্য ঢাকা। সেখানে একটি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে মাহা। শেষবার যখন ঢাকা গিয়েছিল, পাশের সিটে বসে ছিলেন মাহার বাবা। আর আজ? সে একাই যাচ্ছে! মাহার নিষ্পাপ মন খুব করে চাইছে বাবার সান্নিধ্য পেতে। ঠিক আগের মত! কিন্তু মানুষের সব চাওয়া যে পূর্ণতার বেশে ধরা দেয় না তা সে এখন খুব ভালোমতোই বুঝে গিয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বাহিরের দিকে তার চোখ পড়লো । আজকের আকাশটাকে ভীষণ বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কেমন অন্ধকারচ্ছান্ন হয়ে আসছে চারিদিক! মনে হচ্ছে, আকাশের বুক চিড়ে এখনই মেঘগুলো অজস্র বৃষ্টি হয়ে নেমে আসবে!
“মা, এদিকে এসো” – বলে বাসের সামনের সিটের একজন তার ছোট মেয়েকে ডাক দিলো। কন্ঠস্বরটা শুনে মাহা একটু হকচকিয়ে গেল। মনে হয়েছে যেন, মাহার বাবা ডাকছে তাকে। কি আশ্চর্য! মানুষের কন্ঠে এত মিল থাকতে পারে?
মাহা আবারও বাহিরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একে একে ঘর-বাড়ি, ভিটেমাটি, গাছপালা, মানুষ সব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে চোখের পলকে। মাহা ভাবছে, “আচ্ছা, আমাদের প্রিয় মানুষগুলোও কি এভাবেই হারিয়ে যায়?” -হয়ত তাই!
বাবাকে নিয়ে লিখা তারই কবিতার ক’টি লাইন-আকাশ যেন আজ তাকে বারংবার মনে করিয়ে দিচ্ছে-
“আমার বাবা, সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমার,
বাবা নেই-মনে পড়লেই অন্তরটা হয়ে ওঠে ভার!
একদা বাবার সান্নিধ্যে উৎফুল্লতা করত বিচরণ!
এখনও প্রতিনিয়ত করি বাবাকে স্মরণ!
ছায়ার মত যার বাবা থাকে পাশে,
প্রফুল্লতার স্পর্শে আকাশও তখন হাসে!”
আজ আকাশ হাসছে না! গম্ভীর হয়ে আছে! আর মনের পর্দায় জলছবির মত একে একে ভেসে উঠছে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি। বছর দশেক আগে হঠাৎ একদিন মাহা জানতে পারে তার বাবার কঠিন অসুখ হয়েছে। ছোট ছিল বলে মাহাকে অনেক কিছুই জানানো হয় নি তখন। “ডাক্তার সাহেব তার বাবাকে মাত্র ৪ মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে”-এই কথা তখন সে জানত না। তার নিষ্পাপ মন হাজারও স্বপ্ন বুনন করত সেই সময়। সব স্বপ্নেরই প্রাণবিন্দু – তার বাবা। অপেক্ষা শুধু বাবার সুস্থতার। দিন যায়, মাস যায় কিন্তু সেই অপেক্ষার দিন যে ফুরোয় না! আস্তে আস্তে মাহাও বুঝতে পারে বাবা আর কখনো সুস্থ হবে না!
মাহার মনে কড়া নাড়ে -গ্রামের বাড়িতে বাবার সাথে কাটানো সেই দুটি দিনের স্মৃতি। অসুস্থতা যখন বাবাকে ভীষণভাবে আকঁড়ে ধরছিল, ঠিক তখনই তার বাবা নিজের ছেলে মেয়েকে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে কিছু কাজ আছে তা যে শেষ করে আসতেই হবে! বাসের টিকেট পেতে দেরি হওয়ায়, গ্রামে যেতে দুইদিন দেরি হলো।
গ্রামে যাওয়ার পর মাহা নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করল! যেই গ্রাম-বাংলার রুপ তার কাছে একসময় মনোমুগ্ধকর লাগত, সেই অপরূপ সৌন্দর্য মাহার মনকে পুলকিত করতে পারে নি তখন! শঙ্কা প্রতি মুহূর্তে যেন গগন স্পর্শ করছিল! অনেক বছর পর গ্রামে এসেছে শুনে দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই তাদের দেখতে এসেছে। ফেরার দিন, বাবা যখন একে একে সকলকে বিদায় দিচ্ছিল, কেমন যেন একটা অসহায়ত্বের ছাপ বাবার চোখে-মুখে ভাসছিলো। মানুষ যখন জানে, তার হাতে বেশি সময় নেই, তখন হয়ত “ভেতরের এক শব্দহীন আর্তচিৎকার” এমন করেই চোখে মুখে ভেসে ওঠে!
মাহার আজ মনে হচ্ছে, সেদিনই তো বাবার সাথে গ্রাম থেকে ফিরেছে সে। ফেরার পথে বাবার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে পড়ছিল মেয়ের কাঁধে। বাবার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল সে। আহ, কি মনোমুগ্ধকর মুহুর্ত!
দেখতে দেখতে দশটি বছর কেটে গেল বাবাকে ছাড়া। হয়ত আরও কেটে যাবে বহু বছর। কিন্তু স্মৃতিরা তো মানুষের মত হারিয়ে যায় না। বাবার প্রতিটি স্মৃতি আজও খুব যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে মাহা! বাবার কথা মনে পড়লেই তার ভেতরে একধরণের শূন্যতা অনুভব হয় আর তা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে-ঠিক আজকের মত!
বাহিরের তুমুল বৃষ্টি দেখে মাহার মনে হচ্ছে, আজ আকাশও হয়ত টের পেয়েছে তার ভেতরের গগনবিদারী আর্তনাদ!!!
এরকম আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন।
লেখক
তাসফিয়া
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট।
YSSE