বরিশাল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি জেলা। এই বরিশাল নামকরণ কিভাবে হয়েছে জানেন? এ বিষয়ে মতের পার্থক্য রয়েছে। অনেকেই মনে করেন পূর্বে এই অঞ্চলে অনেক বড় শাল গাছ ছিল। এই বড় শাল গাছ থেকে বরিশাল নামের উৎপত্তি। বরিশাল যেমন পরিচিত তার আঞ্চলিক ভাষার দ্বারা তেমনি নানা রকমের পিঠা পুলি, সুস্বাদু খাবারের জন্যও বিখ্যাত। এছাড়াও রয়েছে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানসমূহ। কিন্তু এই অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ রয়েছেন যাদের কীর্তি অবিচ্ছেদ্য। আজকে তাদের নিয়েই লেখা এই ব্লগ।
এ কে ফজলুল হক
শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশাল জেলার বানরীপাড়া থানার চাখার গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এক মহান বাঙালি আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ, যিনি লাহোর প্রস্তাব পেশ করে একটি স্বাধীন পাকিস্তানের জন্য পথপ্রশস্ত করেছিলেন। তবে, তাঁর জীবনের প্রকৃত দৃষ্টান্ত ছিল তাঁর জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাদের জন্য তিনি যা করেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়।
শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের উদ্যোগে আমাদের দেশের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি ছিলেন সেই প্রথম নেতা, যিনি ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। তাঁরই নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ, লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ সহ আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা আজও আমাদের মাঝে তার মহান অবদান স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ. কে. ফজলুল হক ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল প্রায় ৮৯ বছর বয়সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তবে তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও, তাঁর আদর্শ, কাজ ও সংগ্রাম চিরকাল আমাদের হৃদয়ে জীবিত থাকবে। যতদিন বাঙালি জাতি বেঁচে থাকবে, ততদিন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমর বীর, শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৭ই মার্চ বরিশাল জেলার, বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে। মাওলানা আবদুল মোতালিব হাওলাদার এবং সাফিয়া খাতুনের জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে বেড়ে ওঠা এই বীর সন্তানের জীবন ছিল সাহস ও ত্যাগের প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ সময়ে, যখন দেশটি সঙ্কটের মুখে, মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে, এবং তার অসামান্য অবদানকে চিরকাল স্মরণীয় করে রেখেছেন। তাঁর বীরত্বের জন্য তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাব দেয়া হয়। এই খেতাব শুধু তাঁর সাহসিকতার নয়, বরং স্বাধীনতার সংগ্রামে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তার জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, তার পরিবার এবং গ্রামবাসীর ইচ্ছানুসারে তার ইউনিয়নের নাম “আগরপুর” থেকে পরিবর্তন করে রাখা হয় “মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর” ইউনিয়ন। বরিশাল জেলা পরিষদ তার পরিবারের দেওয়া ৪০ শতাংশ জমির ওপর ২০০৮ সালে নির্মাণ করেছে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে একজন অবিস্মরণীয় বীর ও অনন্য যোদ্ধা ছিলেন।
জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন অমর বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই মহাপুরুষ বাংলা সাহিত্যকে নতুন এক দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছেন।
তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার এক মাইলফলক স্থাপনকারী ছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব ছিল, তবে দ্রুতই তিনি নিজস্ব পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন এক মৌলিক কবি। তার রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে যে অনবদ্য সৌন্দর্যে আবহমান বাংলার চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে তিনি “রূপসী বাংলার কবি” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কালসচেতন কবি, যার প্রতিটি শব্দে প্রবাহিত ছিল সময়ের রুক্ষতা, ইতিহাসের যন্ত্রণা।
দুঃখজনকভাবে, ১৯৫৫ সালে কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন এবং ২২ অক্টোবর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তবে তার সৃষ্টির বিশালতা ও বোধের গভীরতা চিরকাল বাঙালি সাহিত্যের সোনালী অধ্যায় হয়ে থাকবে।
সুফিয়া কামাল
বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন বাংলাদেশের এক অমর কবি, লেখিকা, নারীবাদী এবং আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের এক মহীয়সী নেত্রী। ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই মহিয়সী নারী ছিলেন সাহসিকতা, চেতনা এবং অবিচল এক সংগ্রামী চরিত্র।
তিনি ১৯৫০-এর দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার সংগ্রামী জীবন কেবল নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি দেশের স্বাধীনতার প্রতি অবিচল দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছিলেন। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য তিনি নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক ।
১৯৯৯ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান, কিন্তু তার ত্যাগ, সংগ্রাম ও সাহসিকতা আজও আমাদের মাঝে জীবিত। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার বিদায় অনুষ্ঠিত হয়, যা তার অসীম কৃতিত্বের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে থাকবে।
হানিফ সংকেত
হানিফ সংকেত বাংলাদেশের বিনোদন জগতের এক অনন্য নাম। ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর বরিশালের কড়াপুরে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাবান মানুষ ইত্যাদি দিয়ে যুগের পর যুগ দর্শকদের মুগ্ধ করে আসছেন। উপস্থাপক, লেখক, পরিচালক ও প্রযোজক—সব ভূমিকাতেই তিনি সফল। সমাজ সচেতনতা ও শিক্ষণীয় বিনোদনে তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর এই অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক। কিন্তু পুরস্কারের চেয়ে বড় যা, তা হলো মানুষের ভালোবাসা, যা তিনি তার কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অর্জন করে চলেছেন।
বরিশাল শুধু সুন্দর প্রকৃতির জন্য বিখ্যাত নয়, এখান থেকে উঠে এসেছেন অনেক গর্বের মানুষ। ফজলুল হকের নেতৃত্ব, মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সাহস, জীবনানন্দের কবিতা, সুফিয়া কামালের লড়াই আর হানিফ সংকেতের বিনোদন—সব মিলিয়ে বরিশাল এক অনন্য জায়গা। তারা শুধু বরিশালের নয়, পুরো দেশের গর্ব। সময় বদলাবে, কিন্তু তাদের কাজ আর গল্প চিরদিন আমাদের মনে থাকবে।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা
আনিকা শারমিলা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE