দেশে দিন দিন বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশিরভাগ জ্বালানি নির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেশি হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে ডলার সংকটে ভুগতে হচ্ছে। ফলে সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের কাজ করা দরকার। এই‌ক্ষেত্রে বর্জ্য একটি অমূল্য সম্পদ বলা যায়।যাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

“যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন”- এই প্রবচনটির অর্থ হলো, অনেক তুচ্ছ জিনিসের মধ্যেও মুল্যবান কিছু থাকতে পারে। প্রয়োজন শুধু অনুসন্ধান ও যথাযথভাবে তা উৎগাঠন করা। মানুষ তার গভীর উদ্ভাবন ও সৃজশীলতাকে কাজে লাগিয়ে জগতের অনেক তুচ্ছ উপাদান থেকে কল্যাণকর অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছে। ময়লা- আবর্জনা ও তার থেকে বাদ পড়েনি। প্রতিদিন আমাদের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর একটি নির্দিষ্ট অংশ বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিতে হয় ডাস্টবিনে। যা পরিবেশের ক্ষতি তো করে বটেই মানুষের সাস্থ্যঝুকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এইসব পরিত্যাক্ত দুর্গন্ধময় বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি – উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন নতুন কিছু নয়। বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশে অনেক আগে থেকে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আসছে। এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীন অনেক এগিয়ে। বর্জ্য থেকে প্রতিবছর ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে চীন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, জাপান, ইটালি, থাইল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেনসহ আরও অনেক দেশ বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। আপনাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও ৪৫ হাজার ৭৯৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

বাংলাদেশে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন 

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উপাদন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কাজ পেয়েছে চীনা কোম্পানি। চীনা কোম্পানি নিজ ঝুঁকিতে প্ল্যান্ট স্থাপন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। রাজধানীর আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে দেশের প্রথম বর্জ্য বিদুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবে সরকার।বিদুৎ ঘাটতি হ্রাস ও বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার চিন্তা থেকে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইনসিনারেশন প্ল্যান্ট পদ্ধতিতে অর্থাৎ বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এই বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে প্রতিদিন ৩০০০ টন মিক্সড বর্জ্য থেকে ৪২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫,৩২৫ কোটি টাকা। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৮ দশমিক ২৯৫ টাকা। এই প্ল্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ২০২৫ সালের মধ্যে।

বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের সুবিধা:

  • বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপন্ন করা যায় যা শক্তির বিকল্প উৎস দেয়।
  • বর্জ্য পদার্থ থেকে শক্তি উৎপাদন বর্জ্য নিষ্পত্তি সমস্যার সমাধান করে।
  • বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে, এটি ল্যান্ডফিলে প্রবেশ করা বর্জ্যের পরিমাণকে উল্লেখ্যযোগ্যভাবে হ্রাস করে। যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং মুল্যবান জমি সংরক্ষণ করতে পারে।
  • বর্জ্যকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয় যা মাটির পুষ্টির গুনাগুনকে বৃদ্ধি করে।
  • বর্জ্য শক্তি প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে, এটি কেবল বিদ্যুৎ নয়, চাকরির সুযোগও তৈরি করে দেয়। যার ফলে অনেক মানুষের কর্মংস্থানের সুযোগ হয়।
  • বর্জ্য পদার্থ থেকে শক্তি উৎপাদন শহরগুলিকে তাদের বিদ্যুৎ চাহিদায় স্বনির্ভর করে  তোলে।

প্রতিনিয়ত দেশের জসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে মানুষের চাহিদা। তবে সেই অনুযায়ী বাড়ছে না জায়গা-জমি। কারণ আমাদের ফেলে দেওয়া সেই বর্জ্য স্তূপ আকারে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনি নদী-নালা,জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব বর্জ্যরে কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ঢাকার আমিন বাজার বর্জ্য ফেলার প্রধান একটি স্থান। সেখানে গেলে দেখা যায়, বর্জ্য ফেলতে ফেলতে বিশাল পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। নদী- নালা , খাল-বিলে বর্জ্য ফেলতে ফেলতে এমন অবস্থা হয়েছে যে সেখানে বর্জ্যের উপর দিয়েই পশু- পাখি হাঁটা-চলা করছে।বর্জ্যরে দুর্গন্ধে সেখানর আশপাশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার পাশাপাশি যাতায়াত করতেও সমস্যা হচ্ছে। বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে এই বর্জ্য নিষ্পত্তি পাবে এবং যাতায়াতের সমস্যার সমাধান হবে।

বর্জ্য এমন একটি সম্পদ যা শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে নয় গাছ-পালায় প্রাকৃতিক সার হিসেবে ও এই বর্জ্য দেওয়া হয়। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পও শুধু ঢাকায় বাস্তবায়ন করলে হবে না। পাশাপাশি অন্যান্য জেলায় এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে ।  যেইসব জায়গায় এখনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উন্নত হয়নি সেইসব জায়গা বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথাযত ব্যবস্থা গ্রহন করা দরকার। বিশেষ করে গ্রাম ও পাহাড়ি অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা তেমন উন্নত হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের নেওয়া প্রকল্প যথাযতভাবে বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুৎতের ঘাটতি অনেকটা পূরণ হবে।

পরিশেষে বলা যায়, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যেমে বর্জ্যেরও যেমন সঠিক ব্যবহার হবে ঠিক তেমনি দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। আমরা ফিরে পাবো একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন দেশ।  

আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন.

 

লেখক,

সুলতানুল আবরার রাফি

ইন্টার্ন

কন্টেন্ট রাইটিং বিভাগ, YSSE