ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেনথাম একবার রাশিয়ায় তার ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যান। তো বেনথামের ভাইয়ের অফিসকর্মীরা ছিলেন ফাঁকিবাজ ধরণের। ফাঁকিবাজ কর্মীদের ঠিক করতে তাই তিনি এক ফন্দি আঁটেন। সেটা হলো, অফিসের কাঠামোয় একটু পরিবর্তন আনা- সবাই চারপাশে যে যার মতো কাজ করবে আর সবার কেন্দ্রে থাকবে একজন পর্যবেক্ষণকারী যে তদারকি করবে কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, অনেকটা বাপ-দাদার আমলের সেই লজিং মাস্টার প্রথার মতো। চমকপ্রদ এই ধারণা জেরেমি বেনথামের মনে ধরে। এখান থেকেই তাঁর মাথায় আসে খেলে যায়  প্যানোপটিকনের চিন্তা। 

বেনথামের প্যানোপটিকন মূলত ছিল এমন একটা বৃত্তাকার কারাগার যার ঠিক মাঝে থাকবে একটা ওয়াচটাওয়ার। টাওয়ারে একটা উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা থাকবে যা কারাগারের সেলগুলোর উপর সার্বক্ষণিক জ্বালা থাকবে। এতে করে পর্যবেক্ষণকারীকে কয়েদিরা দেখতে পাবেননা এবং পর্যবেক্ষণকারী মানুষ যদি পুরোটা সময় নাও খেয়াল রাখতে পারেন বা কোনো পর্যবেক্ষণকারীই না থাকে, তারপরও কয়েদিরা মনে করবে তাদেরকে সবসময় দেখা হচ্ছে, সিনেমায় যেমন হেলিকপ্টারের সার্চলাইট দিয়ে অপরাধীকে খোঁজা হয় এবং অপরাধী যেরকম তটস্থ থাকে সেরকম। এখন এখানে শুধু পর্যবেক্ষণকারী তো আর একই সময়ে সব সেল পর্যবেক্ষণ করতে পারবেনা। কিন্তু এই আলোর ফলে কয়েদিরা ভাবছে যে তারা প্রতি মুহুর্তেই নজরদারির ভেতর আছে। অর্থাৎ প্যানোপটিকনের ধারণাটা হলো: একটা কারাগারের গঠন এমন হবে যে সেখানে প্রতি কয়েদি এই বিষয়টি উপলব্ধি করবে যে সে প্রতি মুহুর্তে নজরদারিতে আছে। এতে করে যেটা হবে কয়েদিরা সবসময় নিজের আচরণ নিয়ে সতর্ক থাকবে। জেল পালানো সবসময়ই একটা বড় চিন্তার কারণ হলেও এরুপ কাঠামোয় একজন কয়েদি হয়তো এই চিন্তা মাথায় আনার সাহস পাবেনা।

রুঢ় বাস্তবতা হলো জেরেমি বেনথামের এই প্যানোপটিকনের ধারণা কারাগারের বিবর্তনে তেমন একটা সফল হয়নি। এখনকার কারাগারগুলোতে আর এরকম গঠন দেখা যায়না। কারাগারের ক্ষেত্রে সফল না হলেও বাস্তব দুনিয়ায় প্যানোপটিকনের উপস্থিতি অনেক জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রযুক্তিগত ব্যাপারগুলোতে প্যানোপটিকনের একটা ছাপ লক্ষ্য করা যায় ভালোভাবেই। যেমন, সিসিটিভি সম্ভবত প্যানোপটিকনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই মুহূর্তে। যে জায়গায় সিসিটিভি আছে সেখানে আমাদের উপর যে কেউ নজর রাখছে সেটা আমরা সরাসরি দেখছিনা। একটা ক্যামেরা কেবলমাত্র আমাদের রেকর্ড করছে সেটাই দেখছি। কিন্তু এতেই হয়তো আমরা নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছি যে এখানে কী করা উচিত আর কী উচিত না।

কোথাও কোথাও আপনি হয়তো দেখে থাকবেন রাস্তার পাশে ইলেকট্রনিক বোর্ড, যেখানে কিছুক্ষণ পরপর সংখ্যা দেখা যাচ্ছে। এটার নাম রাডার স্পিড সাইন। এটা আসলে ওই মুহুর্তে ওই রাস্তা দিয়ে কোন গাড়ি কত গতিতে যাচ্ছে তা জানার একটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। আপনার গাড়ির গতি মাপা হয়ে যাচ্ছে কোনো মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই কিন্তু একটা প্রযুক্তিগত প্যানোপটিকনের মাধ্যমে। যদি অতিরিক্ত গতি থাকে তাহলে এই ইলেকট্রনিক বোর্ডটা আপনার জন্য একটা সতর্কবার্তা। ধরা হয়ে থাকে নিজ চোখে দেখা ব্যাপার আরো বেশি প্রভাব ফেলে। আপনি যখন দেখছেন আপনার গতি বাইরের একটা বোর্ডে দেখা যাচ্ছে, তখন সতর্ক হতে চাইবেন প্যানোপটিকনের কয়েদিদের মতো।

সিসিটিভি বা রাডার স্পিড সাইন দিয়ে অনেক ইতিবাচক কাজ করা যায়। যেমন, কোথাও চুরি হলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চোরকে সহজেই শনাক্ত করা যেতে পারে। আবার রাস্তার পাশের ইলেকট্রনিক বোর্ডে কোনো গাড়ি অতিরিক্ত গতিতে চলছে শনাক্ত হলে পুলিশের পক্ষেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হয়ে যায়। 

তবে এইসব ইতিবাচক উদাহরণের মাঝে আছে নেতিবাচক উদাহরণ। এই যেমন ধরুন আপনার ব্যক্তিগত কম্পিউটারের কথা। কম্পিউটারে আপনি যা ব্রাউজ করছেন ওয়েবে সেই তথ্যগুলো কিন্তু জমা থেকে যাচ্ছে আইএসপির কাছে। এখানে কম্পিউটার হলো সেই ওয়াচটাওয়ার, আর আপনি হলেন সে যার তথ্য নেওয়ার মাধ্যমে পরোক্ষ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে কিছু জানানো হচ্ছেনা বা কার কাছে তথ্য যাচ্ছে তা জানতে পারছেন না। 

কম্পিউটারের মতোই জীবনকে আধুনিক করে দেওয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা উঠলে মাঝেমধ্যেই শোনা যায় যে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের তথ্য বেহাত হওয়ার খবর, তাই সেখানে দেওয়া ব্যক্তিগত তথ্য যে নজরদারিতে নেই সেই নিশ্চয়তা আপনি পাচ্ছেন না। 

আবার মাঝে পেগাসাস নামে একটা স্পাইওয়্যার নিয়েও আলোচনা হয়েছিল বেশ। এই স্প্যাইওয়্যার সক্ষম ছিল ফোন থেকে ব্যক্তিগত তথ্যে নজরদারি করা থেকে এমনকি ফোন ব্যবহারকারীকে ক্যামেরার মাধ্যমে দেখাও। তবে এইরকম নেতিবাচক উদাহরণের সাথে বেনথামের প্যানোপটিকনের একটা পার্থক্য আছে। তা হলো প্যানোপটিকনে কয়েদিরা জানত যে তারা নজরদারিতে আছে কিন্তু স্প্যাইওয়্যার আপনার ফোনে নজরদারি করলে সেটা বোঝাটা কষ্টসাধ্য।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।

 

রাইটার

আসিফ মাহমুদ

কন্টেন্ট রাইটিং ইন্টার্ন 

YSSE