মোঘল শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জমিদারি প্রথা মূলত একটি স্বায়ত্বশাসিত সামন্ত ব্যাবস্থা। মোঘল সম্রাটগণ স্থানীয় অঞ্চল দেখাশোনার জন্য এসব জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং জমিদারদের হাতে এসব জায়গির ছেড়ে দেন শাসনকার্য পরিচালনার জন্য। একটা সময় জমজমাট, লোকে লোকারণ্য থাকা এসব জমিদারদের বাড়ি সময়ের আবতর্নে ফাঁকা হয়ে গেলেও ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক এবং বাহক এই স্থাপনাগুলো।
তাজহাট জমিদার বাড়ি:
বাংলাদেশের অন্যান্য জমিদার বাড়ির চেয়ে তাজহাট জমিদার বাড়ির বিশেষত্ব হলো এর সিড়ি। ইতালিয়ান পাথর এবং নকশা অনুকরণ করে তৈরি এই সিড়িটি আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করে তাজহাট জমিদার বাড়িকে। তাজহাট জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয় রত্নব্যবসায়ী মান্নালালের হাত ধরে। ১৯১৭ সালে ভবনটির নির্মান কাজ পূর্ণাঙ্গ ভাবে সমাপ্ত হয়। এই জমিদার বাড়িটির মাঝবরাবর একটি গম্বুজ এবং মসজিদের মতো আকৃতির গঠনশৈলি দেখে ধারণা করা হয় এটি মোগল স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। দেখতে মনোরোম সুন্দর এই প্রাসাদটিতে ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘর এর স্থানান্তর ঘটে, যেখানে রয়েছে দশম এবং একাদশ শতাব্দীর বেশ কিছু টেরাকোটার শিল্পকর্ম। সংস্কৃতি এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু পান্ডুলিপি সহ এখানে আরো রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কার কুরআন, মহাভারত এবং রামায়ণের মতো পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ।
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি :
ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এটি। একটি নিম্নবিত্ত হিন্দু পরিবার সাহাদের হাত ধরে এই জমিদার বংশের উদ্ভব ঘটে। এই জমিদারি বংশের পূর্ব পুরুষ গোবিন্দ রায় সাহা ছিলেন একজন বিশিষ্ট লবণ ব্যাবসায়ী। ঢাকার অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এই জমিদার বংশেরই একজন কিশোরীলাল রায়। এক সময় এই জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে রথ উৎসব হতো। বর্তমানে যা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গ্রীক স্থাপত্যের মতোই কারুকার্য শোভিত এই জমিদার বাড়ির স্তম্ভগুলো। গ্রীক স্থাপত্যে সজ্জিত এই জমিদার বাড়িতে আজও রাধা-বল্লবের পূজা হয়।
মহেরা জমিদার বাড়ি :
বাংলাদেশের সবচেয়ে সংরক্ষিত জমিদার বাড়ির মধ্যে অন্যতম একটি স্থাপনা এই বাড়ি। এই জমিদারির পূর্ব পুরুষ দুই ভাই কালীচরণ সাহা এবং আনন্দ সাহা কলকাতা থেকে বাংলা অঞ্চলে এসেছিলেন ব্যাবসায়ী কাজে। এরপর সুবিশাল ভূসম্পত্তির মালিকানা এবং জমিদারি অর্জন। জমিদার বাড়িটি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর অঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলো এই জমিদার বাড়ি। জমিদার পূর্বপুরুষরা এই অঞ্চলের উন্নতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে জমিদার বাড়ির কূলবধূ সহ ৫ জনকে পাক-হানাদাররা হত্যা করলে বাকি সদস্যরা দেশ ত্যাগ করে চলে যান। এরপর শুধুমাত্র পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি চিহ্ন আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটি সাহা বংশীয় জমিদার বাড়ি; মহেরা জমিদার বাড়ি!
উত্তরা গণভবন :
কবি জীবনানন্দের বনলতা সেনের অঞ্চল নাটোর শহরে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটির পূর্ব নাম দীঘাপাতিয়া রাজবাড়ি। মূলত দীঘাপতিয়ার রাজবংশের বাসস্থান এই বাড়িটি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে (৪৭-৫০) এর মধ্যে দেশ ত্যাগ করেন এ অঞ্চলের রাজা। এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে এ বাড়িটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “উত্তরা গণভবন”। এই বাড়িটি একটি পরিখা এবং সুউচ্চ প্রাচীর দাঁড়া বেষ্টিত। প্রাসাদটিতে এখনো রাজসিংহাসন এবং রাজার শয়নকক্ষে ব্যাবহৃত খাটটি রয়ে গিয়েছে। এই প্রাসাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট হলো এখানে অনেক দূর্লভ এবং প্রাচীন জাতের গাছের সমাবেশ রয়েছে। এছাড়াও ভবনটির আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম নিজের পছন্দ অনুযায়ী আনিয়েছিলেন ইতালি থেকে। দীঘাপাতিয়ার রাজাদের শৌখিন স্মৃতি আঁকড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে দীঘাপাতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন।
শিতলাই জমিদার বাড়ি :
পূর্ব পুরুষদের থাকা সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের জমিদারি পাবনার শিতলাই অঞ্চলে ১৯০০ শতকে স্থানান্তর করেন যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রেয় এবং নির্মান করেন শিতলাই জমিদার বাড়ি। বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় জমিদারির ২০০ বছরের ইতিহাস। এই জমিদার বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ হলো বিশালাকারের একটি দীঘি। এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। আজও অবকাঠামোগত দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে এই জমিদার বাড়িটি।
আরো এরকম ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লেখক
মারজানা আক্তার মারিয়া
ইন্টার্ন
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE