আঙ্গুর পছন্দ করেন না এরকম মানুষের সংখ্যা খুব কম। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের সবারই যেন আঙ্গুরের প্রতি একটা আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। বছরব্যাপি জনপ্রিয়তাও থাকে চোখে পরার মতো। একদিকে এটি যেমন ফল হিসেবে সুস্বাদু ,অন্যদিকে আঙ্গুরের রয়েছে বিশেষ উপকারিতা। তাই বিশ্ববাজারে আঙ্গুরের চাহিদাও ব্যাপক। একটা সময় ছিল যখন আঙ্গুরের আমদানিতে প্রচুর অর্থব্যয় করতে হতো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আঙ্গুরের চাষের গল্প করাও যেন পাগলের প্রলাপের মতোই শুনাতো। কিন্তু দিন পাল্টিয়েছে। এখন দেশেই বাণিজ্যিকভাবে আঙ্গুরের চাষাবাদ শুরু হয়েছে। চলুন আজকে সেরকম কয়েকজন উদ্যোক্তার গল্পে গল্পে বাংলাদেশে এটির সম্ভাবনার ব্যপারে জেনে নেওয়া যাক।
আঙ্গুর একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। সাধারণত লতানো ধরনের গাছে থোকায় থোকায় ধরে ফলটি। গাছের ব্যপ্তি ১০–২০ ফিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। গড়ে একটি আঙ্গুর গাছ ২৫–৪০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। রোপনের ৭–৮ মাসের মাথায় ফুল আসে। তা ২ সপ্তাহ পরেই ফলে রূপান্তরিত হয়। ফল পাকতে ২–৩ মাস সময় নিতে পারে। বছরে দুইবার ফল সংগ্রহ করা যায়। প্রতি থোকাতে ১০–১০০ টি আঙ্গুর ধরে যার ওজন ৫০–৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। রোগ বালাইয়ের তেমন ঝামেলাও নেই আঙ্গুর চাষে। মাজরা পোকা ও ছত্রাকের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েই আঙ্গুরের চাষ করা যায়।
আঙ্গুরের উৎপাদন মূলত ৩টি উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। সেগুলো হলো :
১. খাওয়ার জন্য : মূলত খাওয়ার জন্যই মিষ্টি আঙ্গুরের চাহিদা ব্যাপক। এটিতে বিচি থাকে আবার কিছু জাতে বিচি থাকে না। জাত ভেদে রঙেও বৈচিত্র দেখা যায়।
২. মদ তৈরি : বিশ্বের উৎপাদিত আঙ্গুরের ৭৫%–ই ব্যবহৃত হয় মদ তৈরিতে। এর জন্য টক জাতের আঙ্গুর ব্যবহার করা হয়। অধিকাংশই seedless বা বিচিহীন। এই জাতের আঙ্গুর খাওয়ার জন্য অতটা প্রসিদ্ধ নয়।
৩. কিসমিস : এর জন্য ব্যবহৃত আঙ্গুর তেমন সুস্বাদু নয়। এগুলো কিছুটা শুকনো প্রজাতির। ক্যালসিয়াম বাইকার্বোনেট ব্যবহার করে রোদে শুকিয়ে ভিতরের পানিকে বের করে আনা হয়। ভারতের কর্নাটকে রয়েছে উপমহাদেশের বিখ্যাত একটি কিসমিস ফ্যাক্টরি।
বাংলাদেশে ২০০৯ সালে জয়পুরহাট জেলার জামালপুরে প্রকৌশলী রুহুল ইসলাম নিজ উদ্যোগে ৬ বিঘা জমিতে আঙ্গুর চাষ শুরু করেছেন। তিনি সেবছর অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া থেকে দুই ধরণের জাত – Myranda Seedless ও Crimson Seedless এর চারা সংগ্রহ করেন। তারপর দুই ফিটের মতো গর্ত করে সেখানে বালি ও জৈব সার ব্যবহার করে কিছুদিন পর চারা রোপন করেন। চারাগুলো তিনি ৭–৮ ফিট দূরত্ব বজায় রেখে রোপন করেছিলেন। এরপর রড ও সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে মাচা তৈরী করে প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত সূর্যের আলো বাতাস নিশ্চিত করেছেন। তার ২০ মাস পরই তিনি ফল পেতে শুরু করেন। তার বাগানের ৫০০ গাছ থেকে তিনি ৫ টন আঙ্গুরের ফলন পেয়েছেন। একেকটি গাছ বছরে দুইবার ফলন দেয়। তিনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভবিষ্যতে বিদেশে রপ্তানি করারও স্বপ্ন দেখছেন।
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরে জনাব আব্দুর রশিদ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মিষ্টি আঙ্গুর চাষ শুরু করেন করোনাকালীন সময়ে। তিনি তার কয়েকজন বড় ভাইয়ের সহায়তায় ইতালি, ভারতের দর্শনা থেকে Sugarsnow seedless, সোনামুখী সহ আরো কয়েক জাতের মিষ্টি আঙ্গুরের চারা সংগ্রহ করে ৭ কাঠা জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন। প্রথম দিকে চারা রোপনে তিনি মাটি তৈরি করলেও পরবর্তীতে তিনি মাটি তৈরি ছাড়া সাধারণ বেলে–দোআঁশ মাটিতেও অনূরূপ ফলন পেয়েছেন। চারার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নিজেই কলম করে থাকেন। গুটিকলম পদ্ধতিতে উদ্ভিদ হরমোন ব্যবহারে অল্প সময়ের মধ্যেই চারা তৈরি সম্ভব। বর্তমানে তিনি দেড় বিঘার বেশি জমিতে কয়েক জাতের আঙ্গুরের আবাদ করছেন। আঙ্গুর চাষে খরচ খুবই কম হওয়ায় এবং বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনায় তিনি সন্তুষ্ট। তিনি তার আঙ্গুর বাগানকে আরোও সম্প্রসারণের স্বপ্ন দেখছেন। পাশাপাশি নতুন চাষিদের তিনি সাধ্যমতো তথ্য ও চারা সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তাও করে যাচ্ছেন।
মনসুর আলী নামের আরেক সফল আঙ্গুর চাষীর দেখা মিলে যশোর জেলার লেবুবাগান গ্রামে। তিনি বর্তমানে তার ১ বিঘা জমিতে ৮০টির বেশী গাছ রোপন করেছেন। ইউটিউব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকটা ভাগ্যের উপর ভরসা করেই তিনি চারা সংগ্রহ ও জমি তৈরি করে তার শখের আঙ্গুর বাগান গড়ে তোলেন। এলাকাবাসীর তাচ্ছিল্যকে তিনি ৭ মাসের মাথায় তার মিষ্টি আঙ্গুরের মিষ্টতার মায়ায় ম্লান করে দিয়েছেন। এমনকি প্রথমবারের সম্পূর্ণ ফলনই তিনি পাড়া প্রতিবেশীকে মিষ্টিমুখ করানো জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন। এই বাংলার উর্বর সোনাফলা মাটিতে এরকম অনেক মিষ্টি আঙ্গুর চাষি তাদের স্বপ্ন গড়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-র তথ্যমতে, আঙ্গুরের উৎপাদন আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন বেড়ে, ২০২০–২১ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২৮,৭১৫ মেট্রিক টন। এটি ২০১৬ সালের উৎপাদনের প্রায় ১৪৬%! ক্রমাগত এই উৎপাদন বেড়ে চলেছে এবং এতে আমাদের দেশের কৃষকের জীবনের মানোন্নয়ন হচ্ছে। যা কৃষি সম্প্রসারণেও বেশ অবদান রাখছে। বান্দরবান, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি এবং খুলনা জেলায় আঙ্গুরের চাষ হচ্ছে যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে।
ভালো মানের মিষ্টি আঙ্গুর চাষ জনগণের সুস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি, বেকারত্ব ঘুঁচিয়ে ব্যক্তিজীবনে এনে দিতে পারে অভাবনীয় সাফল্য। তাই বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আঙ্গুর চাষ যেন তরুনদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও তরুণদের সাহসী উদ্যোগে আঙ্গুরের চাষাবাদ দেশের অর্থনীতিতে এনে দিতে পারে ব্যাপক অগ্রগতি।
তথ্যসূত্র : Youtube, Dipto, Youtube, Indexbox
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখক,
মোঃ রাকিব রায়হান
ইন্টার্ণ, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট,
YSSE