“বাংলা সাহিত্য” অর্থাৎ বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম হচ্ছে এমন এক ধারা, যে ধারাটি ধরে রেখেছে হাজার বছরেরও অধিক সময়ের ইতিহাস। এই ইতিহাস সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যের ধারক। প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যাত্রা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, এবং এই যাত্রায় আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ধারার বিকাশ, সমাজের প্রতিফলন, এবং মানব জীবনের নানান রূপের চিত্রায়ণ।

এই ব্লগে আমি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগের যাত্রাকে এক সমীক্ষামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।

প্রাচীন যুগ: চর্যাপদ ও শৈব তত্ত্বের সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয় চর্যাপদকে (১০ম-১২শ শতাব্দীর)। চর্যাপদ এক ধরনের বৌদ্ধ গান, যা সহজ-সাহিত্য নামেও পরিচিত। এই গানের মাধ্যমে বৌদ্ধ সাধকরা তাদের ধ্যান ও যোগ সাধনা বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। চর্যাপদের ভাষা আদি বাংলা ও তৎকালীন বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত উদাহরণ। চর্যাপদের সময়কার সাহিত্য মূলত ধর্মীয় এবং দার্শনিক চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন। বৌদ্ধ ধর্ম সহজিয়া মতবাদের প্রভাব এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চর্যাপদে প্রেম, ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে জড়িত তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের: মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব সাহিত্য

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণব সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য ছিল মূলত হিন্দু ধর্মীয় আখ্যান, যেখানে দেব দেবীদের কাহিনি ও তাদের অলৌকিক ক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ও ধর্মমঙ্গল। মধ্যযুগের সাহিত্যিক গীতিকাব্য গুলোর মধ্যে অন্যতম হল বৈষ্ণব সাহিত্য, যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল শ্রীচৈতন্যদেব। বৈষ্ণব পদাবলী বা রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারায় পরিণত হয়, তার উল্লেখযোগ্য কবি বিদ্যাপতিচণ্ডীদাস। এই সাহিত্য ভক্তি ও প্রেমের সমন্বয়ে ভক্তিবাদের উত্থান ঘটায়।

আধুনিক যুগের প্রারম্ভে: বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ

১৮শ শতাব্দীর শেষ ও ১৯শ শতাব্দীর শুরুতে বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা ঘটে, যা ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক চিন্তাধারার সূচনা ঘটায়। এই সময়ে রামমোহন রায় এবং তার সমসাময়িকরা সমাজে শিক্ষার বিস্তার ও সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলা প্রবন্ধ ও সাংবাদিকতার বিস্তার ঘটায়। এই সময়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন এবং রচনা করেন মেঘনাদবধ কাব্য, যা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কাব্যগ্রন্থ। তার পাশাপাশি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার “আনন্দমঠ” এবং “দুর্গেশনন্দিনী” এর মাধ্যমে উপন্যাস ধারার সূচনা করেন। এই সময়ের সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যের গঠনশৈলীতে নতুনত্ব আনেন, যা আধুনিকতার পথে বাংলা সাহিত্যকে ধাবিত করে।

রবীন্দ্র যুগ: বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়

বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ শিখর হিসেবে বিবেচনা করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যুগকে। তিনি বাংলা সাহিত্যকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিচিত করেছেন। কবিতা, গান, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাসের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধশালী করে তোলেন। তার লেখা গীতাঞ্জলি বইটি তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়, যা বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে মানবতাবাদ, প্রকৃতি, সমাজ, প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতা গভীরভাবে উঠে আসে। তার সাহিত্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।

আধুনিক যুগ: সমাজ ও রাজনীতির প্রতিফলন

বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য অনেক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে আরও নতুন ধারা ও প্রবণতা দেখা যায়। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী ও মানবতাবাদী কবিতার মাধ্যমে বাঙালি সমাজে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটানো। তার লেখা “বিদ্রোহী” কবিতা আজও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবিতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পাশাপাশি, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার জগতে এক অন্যরকম প্রভাব সৃষ্টি করেন। তার কবিতায় প্রকৃতি, নিস্তব্ধতা এবং রোমান্টিক চেতনা গভীরভাবে প্রকাশ পায়। তার রচিত “বনলতা সেন” বাংলা কবিতার এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি।

আধুনিক ও উত্তরাধুনিক যুগ: বহুমুখী সাহিত্যিক ধারা

আধুনিক ও উত্তরাধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্য আরও বহু-স্তরীয় ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। জীবনযুদ্ধ, সমাজের বিকাশ, রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ এবং মানব জীবনের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিফলন এই যুগের সাহিত্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। সৈয়দ মুজতবা আলী, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকেরা বাংলা সাহিত্যের এই ধারা বহন করে চলেছেন। উত্তরাধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্য সমাজের জটিলতা, ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক জীবনের দ্বন্দ্ব, এবং বিশ্বায়নের প্রভাব নিয়ে কাজ করছে। উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা এবং নাটকের এই সময়ের সাহিত্যিক আধুনিক চেতনা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রভাব তুলে ধরেন।

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখিকা

আঁখি আক্তার 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE