আমাদের রাজধানী ঢাকা। কারো জন্য এটি তার বসবাসের নগরী, অথবা কারো জন্য এই শহর শুধুই তার শিক্ষা/কর্মস্থল। তবে যাই হোক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্বে একটি অন্যতম জনবহুল মেট্রোপলিটন শহর। এর প্রতিটি কোনায় রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ছাপ।

মুঘল নবাব জাহাঙ্গীরের পত্তন করা এই শহরের আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, সোনারগাও, বড় কাটারা-ছোট কাটারা, তারা মসজিদ থেকে নবাব সলিমুল্লাহর অবদানে সৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় , রমনা পার্ক; সেই সাথে পুরান ঢাকার লোভনীয় সব খাবার আর কাচ্চি বিরিয়ানির সুগন্ধ- ঢাকার এসব নিয়ে আমরা গর্ব করে থাকি। তবে একটি বিষয় মেনে নিতেই হবে—বর্তমানে এমন একটি পরিসংখ্যান উঠে এসেছে যেটা আমাদের মাথা ব্যাথার কারণ। তা হল ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ, এক মারাত্মক সমস্যা যা বর্তমানে আমাদের সামনে উপস্থিত।

নিয়মিতভাবে ঢাকা বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে স্থান পাচ্ছে। এটি কিন্তু কোনো রটনা নয়, AQI বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে দেখা যাচ্ছে ঢাকার বাতাস খুবই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ২২শে ডিসেম্বর ঢাকা শহরের বায়ুর এ কিউ আই ছিল ২৭১, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে গণ্য করা হয়। যেখানে বাতাসে সীসার পরিমাণ 500 ন্যানোগ্রাম/কিউবিক মিটার এর নিচে থাকা দরকার, সেখানে ঢাকার বাতাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ১১০০ ন্যানোগ্রাম। এছাড়াও আর্সেনিকের পরিমাণ থাকা উচিত ৬.৬৯৯ ন্যানোগ্রাম, ঢাকার বাতাসে তার উপস্থিতি ছিল ৩২। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পারি এরকম পদার্থের উপস্থিতি মানুষের সহ্য সীমার কয়েক গুণ পর্যন্ত বেশি যা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিকর।

বলা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এর মধ্যে অন্যতম হবে ফুসফুসের ক্যান্সার। কেনই বা নয়? প্রায় ৩৫ লক্ষ শিশুর রক্তে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ধাতব পদার্থ পাওয়া গেছে। এটি একটি ভয়াবহ দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ, বাতাস যা আমরা আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে অহরহ গ্রহণ করে থাকি, সেটিই যদি বিষরুপ ধারণ করে তবে আমরা কিভাবে বাঁচব? একটি মেট্রোপলিটন শহরের বাতাস চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কারণ এই পরিস্থিতি একদিন দুইদিনে তৈরি হয়নি। এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বছরে পর বছর অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে।

আচ্ছা আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে আপনি কোনটিকে চিহ্নিত করবেন?
জি, প্রথমেই বলবেন যানবাহনের ধোঁয়া। ঢাকা শহরে চলাচল করতে গিয়ে যানবাহনের কালো বিষাক্ত ধোঁয়ার মুখোমুখি হয়নি এমন কেউ নেই। ঢাকার রাস্তায় বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষ যানবাহন চলাচল করে, যার বেশিরভাগই পুরনো এবং ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এসব যানবাহন থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয়, তা বায়ু দূষণের পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্যকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।

দ্বিতীয় অন্যতম বড় কারণ হলো নির্মাণ কাজের ধুলো। ঢাকার রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে অথবা গলির মুখে প্রায় সারা বছরই নির্মাণ কাজ চলতে দেখা যায়। এসব নির্মাণ প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ ধুলো, বালু, এবং অন্যান্য ধাতব পদার্থ বাতাসে মিশে যায়। এই অপরিকল্পিত নির্মাণ কার্যক্রম ঢাকায় বায়ু দূষণের প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের জন্য দায়ী।

ঢাকা শহরের মধ্যে না হলেও ঢাকার আশেপাশের প্রায় ১৫টি ইটভাটা রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন টেক্সটাইল কারখানা, কেমিক্যাল প্লান্ট এবং অসংখ্য শিল্প কারখানা। এসব শিল্প কারখানা থেকে অপরিচিত ধোঁয়া প্রতিনিয়ত বাতাসে মিশে যাচ্ছে এবং বায়ুকে দূষিত করছে। শিল্পাঞ্চলগুলো থেকে বায়ু দূষণের প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমিকা রয়েছে এবং ইটভাটা থেকে প্রায় ৫৮ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।

আমরা দেখতে পাচ্ছি এত বড় একটি দুর্যোগের পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণই দায়ী। প্রশ্ন উঠতে পারে, এত বড় মেট্রোপলিটন শহরে এভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ন, যথাযথ ফিটনেস বিহীন যানবাহন চলাচল, এবং নির্মাণ কাজ চালু—এত কিছু হয়ে গেল কেউ কি ছিল না এগুলো থামাতে? উত্তর হলো, না। নীতি নির্ধারকরা ঢাকার পরিকল্পিত নগরায়নকে উপহাসের বুলি বানিয়ে রেখেছিলেন। কখনোই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুর্নীতি এবং ঘুষ বাণিজ্যের কারণে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যায়নি।

যা হবার তা তো হয়েই গেছে। তবে তাই বলে কি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই? আমরা যদি বলেও থাকি যে সমস্ত কারণে ঢাকার বাতাসের আজকের অবস্থা, নতুন বাংলাদেশে আমরা যথাযথ পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করে সেগুলো দূর করব। কিন্তু তা সুদুর প্রসারী ব্যাপার, এখন এই বিষাক্ততা থেকে মুক্তির উপায় কি?

তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য আমাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মাস্ক ব্যবহার: ঢাকার ভয়াবহ বায়ু পরিস্থিতিতে মাস্ক ব্যবহার করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। করোনার সময়ে আমরা সবাই মাস্ক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ফার্মাসিউটিক্যাল মাস্ক (k95) পরিধান করা যেতে পারে।

গাছ লাগানো ও ছাদ বাগান: ইতোমধ্যে অনেকেই সফলভাবে ছাদ বাগান করেছেন।

বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি এমন জায়গায় অবস্থান কমিয়ে আনা।

এজমা আক্রান্তদের সর্বদা ইনহেলার সাথে রাখা।

ঢাকা শহরে যে কয়টি পার্ক অবশিষ্ট আছে সেখানে যাওয়া, প্রকৃতির বাতাসে শ্বাস নিয়ে কিছুটা দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। ঢাকায় আর অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ / যানবাহন চলবে না। বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে একটি বাস্তবায়নযোগ্য রোডম্যাপ হাতে নিতে হবে। প্রয়োজনে দিল্লি, বেইজিং এর মত অন্যান্য বায়ু দুষনের ভারে ন্যুব্জ শহরগুলো যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নেয়া যেতে পারে।

সর্বোপরি আমাদেরকে সচেতন হয়ে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার এবং জনগণ একসঙ্গে কাজ করলে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভব। নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর স্বার্থের দিকে মনোনিবেশের মাধ্যমে আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি সফল বাংলাদেশ ২.০

আরও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

লেখিকা,
ইসরা আহাম্মেদ ভূঁইয়া
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE