আজ মহান বিজয় দিবস, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। বাঙালি জাতির বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। ২৪ বছরের (১৯৪৭-১৯৭১) শোষণ ছিন্ন করে এ জাতির আকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। বিজয়ের রক্তাভা ছড়িয়ে পড়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয়, জয়বাংলা বাংলার জয়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। মহামুক্তির আনন্দ ঘোর এই দিনে এক নতুন উল্লাস জাতিকে প্রাণ সঞ্চার করে সজিবতা এনে দেয়। বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের তাহার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। বাঙালি যেন খুঁজে পায় তার আপন সত্তাকে। 

বায়ান্ন থেকে শুরু হয় বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে হিসাব-নিকাশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাঙালি শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। ১৯৫২ সালে যে আগুন জ্বলেছিল রাজধানী ঢাকা শহরে, সে আগুন যেন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের আনাচে-কানাচে সবখানে। বাঙালির বুকের ভেতর জ্বলে ওঠা আগুন যেন সহস্র বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে।

৭ মার্চ একাত্তরের বিশাল জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠ ঘোষণা দেন, “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই একটি মাত্র উচ্চারণে যেন বাঙালি সত্যিকার দিক-নির্দেশনা পেয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, “ তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরও দেব, তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। ” তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি একতাবদ্ধ হতে শুরু করে। 

এরপর আসে সেই ভয়াল কালো রাত। ২৫শে মার্চ গভীর রাতে ঘুমন্ত নিষ্পাপ বাঙালির বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল নরপিশাচ। শুরু হয় বাঙালি নিধন যজ্ঞ। বাতাসে লাশের গন্ধ, বারুদে বারুদে আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশ। পাকিস্তানি হানাদার দের নির্মম হত্যার শিকার হয় হাজার হাজার ঘুমন্ত বাঙালি। পরদিন অর্থাৎ ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম। মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার সবাই শরিক হয়ে থাকে এ লড়াইয়ে। যতই দিন অতিবাহিত হতে থাকে, শাণিত হতে থাকে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র। প্রাণ হারায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ, সম্ভ্রম হারায় দুই লক্ষ মা বোন। 

ইতোমধ্যেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী ভারতও জড়িয়ে পড়ে বাঙালির ভাগ্যযুদ্ধে। ডিসেম্বর শেষ পর্যায়ে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয় এই যুদ্ধের।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সময়টা ছিল বিকাল ৫:২৫ মিনিট! নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেদিন ঢাকার কেন্দ্রস্থল রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

বিজয়ের অনুভূতি সব সময়ই আনন্দের। তবে একইসঙ্গে দিনটি বেদনারও, বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের জন্য। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের; যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদের। বীর শহীদদের আত্মত্যাগকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে এই দিনটিকে বাংলাদেশে জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সরকারীভাবে এ দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১৯৭২ সাল থেকে প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখক

ফেরদৌস আরা রিমি

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE