সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন। প্রায় এক দশকের মহামন্দার পর, ১৯৪৪ সালে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে, তখন ৪৪ টি দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ “ব্রেটন ঊডস চুক্তি” স্বাক্ষরের মাধ্যমে ডলারকে বিশ্ব মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। যা আগে ছিলো ব্রিটেন পাউন্ডের দখলে প্রায় এক শতাব্দী ধরে।
পরবর্তীতে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বিনিময়, প্রায় ৯০% ডলারের মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং বিশ্ববাজারে ডলারের আধিপত্য শীর্ষস্থান অর্জন করে নেয়।
বিশ্ববাজারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের আধিপত্য থাকলেও সম্প্রতি বেশ কিছু কারণে তা হয়েছে নিম্নমুখী।
যেখানে ১৯৭০ সালেও বিশ্বের মোট ব্যাংক রিজার্ভের ৮৫ শতাংশ ছিলো ডলারে, গত বছরের শেষে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশে।
ডলারের আধিপত্য হারানোর অন্যতম কারণ ভূরাজনীতি।
দীর্ঘদিন থেকে আমেরিকা ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া সহ বেশ কিছু দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে।
সাম্প্রতিক রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ব্যাপারটাকে আবারও তুলে এনেছে সামনে। নিজ স্বার্থে বারবার ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা এবং নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করার কারণে দেশগুলো আস্থা হারাচ্ছে ডলারে।
এর পরিবর্তে দেশগুলো চীনা রেনমিনবি, ইউরো, পাউন্ড বা জাপানি ইয়েনের মজুদ বাড়িয়েছে যা ডলারের আধিপত্য কমিয়ে দিয়েছে।
ডলারের মানের নিম্নমুখীতার আরেকটি কারণ মুদ্রাস্ফীতি। কোভিড–১৯ এ লকডাউনের কারণে বিশ্বজুড়ে ছিলো স্থবিরতা। কলকারখানা থেকে অফিস আদালত, সবই ছিলো বন্ধ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সেই সময়কালে ৫.২ ট্রিলিয়ন ডলার প্রিন্ট করে। পরিকল্পিত অবকাঠামো ব্যয়ে আরও ২ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করা হয় এবং মোট যুক্তকৃত অর্থ দাঁড়ায় ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা অর্থের প্রচলন ৩৫% বৃদ্ধি করে যা জিডিপির ৬০%।
বিপুল পরিমাণ ডলার ছাপানোর কারণে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ৭ শতাংশেরও বেশি, যা ২০১৯ সালে ছিলো ২.৩৫ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতিতে মান হারানোয় অন্যান্য দেশগুলো তাদের আস্থা হারিয়েছে ডলারের উপর।
সাম্প্রতিক সময়ে চায়না, রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিল ও সৌদি আরবের মিলিত জোট, যা “ব্রিকস” নামে পরিচিত, বিশ্ববাজারে নিজেদের আগমন ঘটিয়েছে। ২০টিরও বেশি দেশ তাদের সাথে যুক্ত হবার আগ্রহ জানিয়েছে।
ব্রিকসের মতে, ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের অর্থব্যবস্থা থাকবে যা সংযুক্ত দেশগুলোর লেনদেনে ব্যবহার করা হবে। তাদের এহেন পদক্ষেপ থেকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্রিকসের মুদ্রা বা কারেন্সি হবে পরবর্তী ডলার, যা “ডি-ডলারাইজেশন” নামে পরিচিত।
সাম্প্রতিক কিছু বড় পরিবর্তনের মধ্যে একটি হল ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রসার। এই সময়ে, বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সির অভিযান চলছে, এবং এটি একটি নতুন অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিয়েছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিশেষভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহারের সম্ভাবনা।
ডলারের মাধ্যমে প্রতিটি লেনদেন যেমন অথোরিটি কতৃক পর্যালোচনা করা যায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি ঠিক তার বিপরীত। ব্যাংকে লেনদেন করতে হলে যেমন অনেক ধাপ বা নিয়ম মেনে করতে হয়, যেটা সময়সাপেক্ষ এবং ত্রুটিযুক্ত; সেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারকারীকে দেয় পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভের কথা বিবেচনা করলেও আমরা মোটামুটি একই চিত্র দেখতে পারবো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের সাথে জাপানি ইয়েন এবং পাউন্ডের মজুত বেড়েছে। এতে ডলারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির উপর প্রভাব কম পড়বে।
রে ডালিও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম যে ইনভেস্টর তিনি উল্লেখ করেছেন, “রিজার্ভ কারেন্সি চিরকাল স্থায়ী হয় না এবং প্রতি ১০০ বছরে পরিবর্তন ঘটে যাকে তিনি “বড় চক্র” নামে অভিহিত করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স ১৭২০–১৮১৫ সাল থেকে রিজার্ভ মুদ্রার অধিকারী ছিল, ১৮১৫–১৯২০ সাল থেকে ব্রিটেন, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীতে এই স্থান দখল করেছে।
প্রশ্ন হল: তারা কতক্ষণ এটি ধরে রাখতে পারে এবং চীনা ইউয়ান কি নতুন রিজার্ভ মুদ্রা হয়ে উঠবে?!
এই উত্তর পেতে আমাদের হয়ত অপেক্ষা করতে হবে কয়েক বছর থেকে কয়েক দশক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সঠিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে আস্থা না ফেরাতে পারে, ডলারকে শক্তিশালী করতে না পারে, আমরা হয়ত ডলারের পতন এবং নতুন বিশ্বামুদ্রার আগমন দেখবো।
এমন লেখা আরও পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
হাসিবুল আহমেদ পুলক
ইন্টার্ন, কন্টেন রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE