‘সফলতা‘ শব্দটি শুনতে যতটা মধুর, অর্জন করা ততটাই কঠিন। কোনো কাজ একবার করে সফলতা পাওয়াটা খুবই দুর্লভ বিষয়। সফলতার খোঁজে বারবার ব্যর্থ হতে হয় আমাদের। সফলতা এবং ব্যর্থতা দুটি শব্দ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বলেই ছোটবেলা থেকে আমাদের শিখানো হয়– ব্যর্থতা সফলতার চাবিকাঠি। তারপরও দুয়েকবার কোনো কাজে ব্যর্থ হলে আমরা হাল ছেড়ে দিই। এই জায়গাতেই একটি বিরাট পার্থক্য তৈরি হয় আমাদের এবং সাফল্যের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো ব্যক্তিদের মাঝে। সফল ব্যক্তিদের জীবন দেখলেই বোঝা যায় কতটা ব্যর্থতার পথ পাড়ি দিয়ে তারা আজ এই পর্যায়ে পৌঁচেছে। তাদের অদম্য আগ্রহ এবং অপ্রাণ চেষ্টা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এর অনুপ্রেরণা স্বরূপ কিছু সফল ব্যক্তির ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প তুলে ধরা হলো।
জে কে রাউলিং
লেখালিখির জগতে সাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে জে কে রাউলিং খুব জনপ্রিয়। তার প্রথম বই ‘হ্যারি পটার এন্ড দা ফিলসফারস স্টোন‘ এর পান্ডুলিপি নিয়ে তাকে বিভিন্ন প্রকাশনীর দারে দারে ঘুরতে হয়েছে। শুধু যে তাকে ১৩ টি প্রত্যাখ্যান এর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাই নয় তাকে হাসির পাত্র ও হতে হয়েছে বহুবার। হার না মেনে তিনি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্লুমসবারি নামক লন্ডনের একটি ছোট প্রকাশনী কোম্পানি থেকে তার বইটি প্রকাশিত হয়। শুধু তাই নয়, তার আরো কিছু ধারাবাহিক লেখা প্রকাশের পর অনেক সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। বিতর্ক থেকে দূরে সরে না গিয়ে তিনি তার সৃজনশীলতা রক্ষার সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত উন্নতি সাধনের চেষ্টা করে গিয়েছেন। তার হ্যারি পটার বইটির মিলিয়ন মিলিয়ন কপি পুরো বিশ্বব্যপী বিক্রি হয়েছে, তার সাথে অর্জন করেছেন অনেক পুরষ্কার ও মানুষের ভালোবাসা।
সইচিরো হোন্ডা
জাপানের হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও মোটরসাইকেলের জনক সইচিরো হোন্ডার জীবনে সাফল্যের ছোঁয়া পেতে বারবার চরম ব্যর্থতার স্বাদ নিতে হয়েছে। ১৯২২ সালে রেসিং কার ডিজাইনের কাজ দিয়ে শুরু করে পিস্টন রিং বানানোর মাদ্যমে তার উদ্ভাবক হওয়ার পথচলা শুরু হয়। নিজের ও স্ত্রীর সকল সম্পত্তির বিনিময়ে পিস্টন ও রেসিং কার বানানো শুরু করলেও সফলতা পাননি। ১৯৩৬ সালে কার রেসিং এর ময়দানে তার এক হাত ভেঙে যায় এবং হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ৩০ হাজারের মধ্যে মাত্র ৩টি পিস্টন কোয়ালিটি কন্ট্রোলে পাশের ও টেকনিক্যাল স্কুল থেকে অব্যাহতির খবর পায়। ১৯৩৭ সালে তিনি আবারো উচ্চ কোয়ালিটির পিস্টন বানিয়ে তা টয়োটা কোম্পানিতে সরবরাহ করতেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তাকে তার ‘টোকাই সিকি’ প্রতিষ্ঠানটি টয়োটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিতে হয়। ব্যর্থতায় নিমজ্জিত না হয়ে ১৯৪৬ সালে ছোট্ট একটি গ্যারেজেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘হোন্ডা টেকনোলজি রিসার্স ইন্সটিটিউট’। মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে মটরাইজড বাইসাইকেল তৈরি এবং বিক্রির কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি রূপান্তরিত হয় ‘হোন্ডা মোটর লিমিটেড’ কোম্পানিতে।ধীরে ধীরে বাইসাইকেল থেকে মোটরসাইকেল বানানোর কাজ শুরু করেন এবং এভাবেই তিনি একজন বিশিষ্ট জাপানী প্রকৌশলী ও শিল্পপতি হিসেবে আজ আমাদের মাঝে জনপ্রিয়।
ওয়াল্ট ডিজনি
অ্যানিমেটেড কার্টুন চলচ্চিত্রের পথপ্রদর্শক হিসেবে সারা বিশ্বে ওয়াল্ট ডিজনি এক নামে পরিচিত। তাছাড়া তিনি মিকি মাউস এবং ডোনাল্ড ডাকের মতো জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র নির্মাণ করেছেন। সংবাদপত্রের কার্টুনিস্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পথচলা শুরু করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে তার পথচলা বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর তিনি একটি কমার্শিয়াল আর্ট স্টুডিওতে ড্রাফটসম্যান এবং ইনকার হিসেবে কাজ করেন। এই অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি নিজের লাফ–ও–গ্রাম নামক অ্যানিমেশন কোম্পানি তৈরি করেন। ১৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করে, কর্মী নিয়োগ দিয়ে তিনি যে পিক্টোরিয়াল ফিল্মসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় সেই ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটরই তার সাথে প্রতারণা করে বসে, যে কারণে ডিজনিকে দেউলিয়া হয়ে তার লাফ–ও–গ্রাম কোম্পানি বন্ধ করতে হয়। এত ব্যর্থতার পর ও পিছিয়ে না পরে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় নতুন উদ্যমে তার স্বপ্ন পূরণ করতে যান। এরপর হলিউডেই চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে সফলতার পথ খুঁজে নেন তিনি।
জ্যাক মা
আলিবাবা গ্রুপ এবং এর মার্কেটপ্লেস আলিবাবা ডট কম ও শপিং সাইট টাওবাও ডট কম এর প্রতিষ্ঠাতা চীনের জ্যাক মা। কলেজ পরীক্ষায় ২ বার ফেল করে ৩য় বারে তিনি সুযোগ পান। চাকরি করতে গিয়েও তাকে অনেকবার ব্যর্থ হতে হয়েছে। পুলিশের চাকরিতে ১০ জনের মধ্যে বাদ পরা এবং কেএফসিতে ২৪ জনের মধ্যে বাদ পরা শুধু তিনিই একজন। এত ব্যর্থতার পর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে চার বছরের অভিজ্ঞতার পর তার প্রথম কোম্পানি ‘হাইবো ট্রান্সলেশন এজেন্সি’ প্রতিষ্ঠা করলেও খুব শীগ্রই সম্মুখীন হন ‘ইন্টারনেট‘ এর এবং চাইনিজ ওয়েবসাইটের গুরুতর অভাব অনুভব করেন, যা মূলত একটা মহান ব্যবসার সুযোগ। এই চিন্তা নিয়েই কাজ করতে করতে অনেকবার সাফল্য অনেকবার ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করে সফলতা পান।
বিল গেটস
ব্যর্থতা থেকে অনুপ্রেরণার গল্পে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এর নামটি অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। শৈশব থেকেই ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ১৯৭৩ সালে আইন বিভাগে পড়াশোনার লক্ষ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি আইনের পড়া ছেরে ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।তার সর্ব প্রথম ব্যবসা ‘ট্রাফ ও ডাটা‘ তে তিনি আশাজনক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হননি। কিন্তু তিনি দ্বিতীয়বার চেষ্টার কোনো কমতি রাখেন নি। ধীরে ধীরে উদ্দীপনার সাথে কাজ করেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাইক্রোসফট’। বিল গেটস এর জীবন থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা নেয়ার বিষয় আছে, কিভাবে তিনি বড় লক্ষ্য অর্জন করার জন্য হার্ভার্ড এর মতো বিশ্বসেরা বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় পৌঁচেছেন।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা
কাজী মিরানা মঈনুদ্দিন
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE