ভাষা আন্দোলন শুধু আমাদের ভাষার লড়াই ছিল না, ছিল আমাদের মুক্তির লড়াই যার সূত্রপাতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা :
ভাষা আন্দোলনের শুরুটা ১৯৫২ তে হয়নি, ১৯৪৮ থেকে ভাষা নিয়ে তোলপাড় হলেও এর সূত্রপাত ঘটার পেছনে রয়েছে আরো কয়েক বছরের ইতিহাস।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্র গঠিত হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। স্বাধীন রাষ্ট্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হবে সেটি ভারতীয় জাতীয় কনগ্রেস আগেই বলেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেটি নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। মূলত পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল বেলুচ, চীন, পাঞ্জাব, পেশোয়ার ও ইস্ট পাকিস্তান নিয়ে। সর্বপ্রথম আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। সাথে সাথে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। যা প্রত্যাখান করা হয় যদিও তৎকালীন ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। আজাদী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যুবলীগ, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমর্থন করেছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেম এর নেতৃত্বে উঠে স্বীকৃতিক প্রতিষ্ঠান তমুদ্দুন মজলিস। এই প্রতিষ্টানটি ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর মেনিফেস্টোরুপি “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” বইটি বের করেন। সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদবির ব্যক্তিগণ বাঙালিগণ উর্দুকে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গি করে নিয়েছিলেন। এছাড়াও ট্রেনের টিকেট, মানি অর্ডার, পোস্ট কার্ড এনভেলপ ফরমে ইংরেজি এর পাশাপাশি উর্দু ব্যবহার করতো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আরো জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে প্রথম আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৭ই নভেম্বর বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের থেকে স্বাক্ষর গ্রহন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্বারক পেশ করেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২৭ই নভেম্বর করাচির একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারন ভাষা করার প্রস্তাব গৃহিত হয় যার প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভা আয়োজিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতে বক্তৃতা দানের দাবি তোলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক কাসেমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১১ই মার্চ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ স্বরুপ পুরো পাকিস্তানে মিটিং, মিছিল ও হরতাল করা হয়। এই আন্দোলনটি সাফল্যমুখী ছিল, চারদিকের অরাজকতাময় পরিবেশকে দমাতে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু তিনিই ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকার পল্টন ময়দানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। যার চূড়ান্তরুপের বহিঃপ্রকাশ হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে।
কারা ছিলেন আন্দোলনের মহানায়ক?
ভাষাসৈনিক হিসেবে দেশের অনেকেরই অবদান রয়েছে। এদের মধ্যে অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু অন্যতম। তিনি ১৯৩১ সালের ২৮ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কমলাকান্তপুরের এক সম্ভ্রন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ছিলেন। তার নেতৃত্বেই মূলত রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালের ১০ই জুলাই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে। তিনিই প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জম্মগ্রহন করেন ২ নভেম্বর, ১৮৮৬। তিনি একজন বাঙালি আইনজীবী সমাজকর্মী, ভাষা সৈনিক ছিলেন। তার পরিচিতি মূলত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতে বক্তৃতা দানের দাবি তুলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ আবুল কাসেম একজন প্রথিতযশা বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজসেবক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্থপতি এবং তমদ্দুন মজলিস ও বাঙলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। আবুল কাশেম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু’ শিরোনামের ঘোষনাপত্রে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্টভাষা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। রয়েছে আরো অনেক ভাষা সৈনিক যারা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের কারণেই আমরা পেয়েছি ভাষার স্বাধীনতা।
ভাষা শহীদ ও তাদের স্মরণে প্রথম স্মৃতি স্তম্ভ :
শত আন্দোলন ও সহস্র প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি মাতৃভাষা বাংলাকে। যারা আমাদের ভাষার জন্যে আত্মাত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার অন্যতম।
বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ রফিকউদ্দিন আহমেদ। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের মিছিলে পুলিশের গুলিতে রফিক ঘটনাস্থলে শহিদ হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর সোয়া তিনটায়।
আবুল বরকত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ২০ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় ছাত্র-জনতার মিছিলে আবুল বরকত শামিল হন। মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় এবং বরকত গুলিবিদ্ধ হন। তিনি ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরন করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটার সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে ঢাকার নবাবপুর রোডে বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালায়। মিছিলে শামিল শফিউর রহমান গুলিবিব্ধ হন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত শফিউর ঐ দিন সন্ধ্যা সাতটায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি অবস্থায় ছাত্র-জনতারা মিছিল করেন মিছিলে ছিলেন আবদুস সালাম। মিছিলে পুলিশের গুলিতে আবদুস সালাম মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে তিনি ৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান।একইভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সমাবেশরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন আবদুল জব্বার। ঐদিন রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুল জব্বার মারা যান।
শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য রাজশাহীতে সাধারন ছাত্ররা নির্মান করেন শহীদ মিনার। যা ২৩শে ফেব্রুয়ারীর রাতের মধ্যেই নির্মিত হয়। সে সময় রাজশাহী কলেজের ভেতর ভবন নির্মাণের কাজ চলছিল। সেখানে বেশ কিছু ইট পড়েছিল। রাতেই ওই ইট ও কাদা দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়, যা ছিল দেশের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। রাতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে সবাই চলে যাই এবং সামরিক সেনারা ২৬শে ফেব্রুয়ারীতে নিশ্চিন্হ করে দেয়।
কিভাবে পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি?
২০০০ সালের পূর্বপর্যন্ত আমরা বাঙালীরা এ দিনটিকে শুধু শহীদ দিবস (শোক দিবস) হিসেবে পালন করে আসছি। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারীকে ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়।
এর পর থেকে বিশ্বব্যাপী দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতেও আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, লেগেছে অনেক লবিং কুটনৈতিক প্রচেষ্টা। দু‘জন কানাডা প্রবাসী বাংলাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালায়ের উপাচার্য পরবর্তিতে লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার জনাব সাইদুর রহমান খান সহ ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইউনেস্কতে প্রেরণ করেন। এই প্রতিনিধি দল প্যারিসে দু‘সপ্তাহ অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের কুটনীতিকদের সাথে লবিং শুরু করেন। লবিষ্টদের ভাষ্যমতে যে পাকিস্তান আন্দোলনকারীদের উপর ১৯৫২সালে গুলি চালিয়েছিল সেই পাকিস্তানও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার পক্ষে ভোট দেয়। বাংলাদেশ সরকারের লবিংয়ের কারনে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে।
To read more blogs,click here
লেখিকা
মৌসুমী আক্তার রিতু
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE