মার্কিন ডলার (USD) বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, এবং আর্থিক লেনদেনে সর্বাধিকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বে প্রায় ৯০% অর্থনৈতিক লেনদেন হয়ে থাকে ডলারের মাধ্যমে, যা এই মূদ্রাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রিজার্ভ মূদ্রায় পরিণত করেছে। আন্তর্জাতিক বানিজ্য বা লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের সমতূল্য কোনো মূদ্রা নেই। আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড এর মতে, বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ গুলোতে ৫৯% মূদ্রা রাখা হয় ডলারে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউরো। 

এর প্রভাব এতটাই গভীর যে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারণে ডলারের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে ডলার হয়ে উঠলো বিশ্বের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক।

মার্কিন ডলারের উত্থান

উনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাজ্যের মূদ্রা পাউন্ড স্টালিন ছিলো বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী মূদ্রা। তখন যুক্তরাজ্যের স্বর্ণ মজুদ ছিলো সবচেয়ে বেশি। ১৮৭০ এর দশকে আমেরিকা অন্যতম অর্থনৈতিক প্রভাবশালী দেশে পরিণত হয়।

বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। যুদ্ধে অস্ত্রসস্ত্র কিনতে রিজার্ভের বেশিরভাগ স্বর্ণ খরচ হয়ে যায়। এইসময় বিশ্বজুড়ে ৭০% এর বেশি স্বর্ণ চলে যায় আমেরিকার কাছে। এছাড়াও আরও খরচ বহন করতে স্বর্নের মজুদের ভিক্তিতে যত পরিমাণ মূদ্রা ছাপানো সম্ভব ছিলো তার চেয়েও বেশি নোট ছাপানো হয়। ফলে তাদের মূদ্রা ব্যবস্থা চাহিদা ও যোগানের ওপর নির্ভরশীল হলে চারিদিকে ফিয়াট মূদ্রা ছড়িয়ে পরে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম কয়েক বছর যুদ্ধে প্রতক্ষ্যভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে এবং ইউরোপসহ অন্যান্য দেশগুলোর স্বর্ণের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধেও পুনরাবৃত্তি ঘটে যেখানে আমেরিকা আড়ায় বছর যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকে দেশগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র বিক্রি করে।  বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর স্বর্ণ পেয়ে আর্থিক ভাবে ফুলে ফেঁপে উঠে। 

ব্রেটন উডস চুক্তি 

এসময় পুরো বিশ্বজুড়ে  অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এই অর্থনৈতিক সচলতাকে ফিরিয়ে আনতে  বিশ্বের ৪৪টা দেশ মিলে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষর করে। যেখানে আমেরিকান ডলার দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মূদ্রা মান নির্ধারন করতে রাজি হয় দেশগুলো। আমেরিকা পরিনত হয় বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশে। যেখানে ডলারের মান নির্ধারন করা হয় অস্ত্র বিক্রির স্বর্ণ দ্বারা। এভাবেই ডলার হঠাৎ করে সবচেয়ে প্রভাবশালী হার্ডকোর কারেন্সিতে পরিনত হয়।

মার্কিন ডলারের একাধিপত্য 

বিশ্বজুড়ে তেল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এই পদ্ধতিকে বলা হয় “পেট্রোডলার সিস্টেম।” যদি কোনো দেশ তেল কিনতে চায়, তাহলে তাদের মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। ১৯৭১ সালে আমেরিকা সৌদি আরবের কাছে ডলারের বিনিময়ে তেল রপ্তানিতে চুক্তি করে। ধীরে ধীরে মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য দেশ ও ডলার দিয়ে তেল কিনতে থাকে। এটি মার্কিন ডলারের চাহিদা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের আধিপত্য স্থায়ী করে।

অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বানিজ্য সম্পাদন ও চুক্তি ডলারে হওয়ায় দেশগুলো ডলার রিজার্ভ করে রাখে। এছাড়াও মার্কিন অর্থনৈতিক বাজারগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারিরা তাদের সম্পদ ডলারে মজুদ করে রাখতে পছন্দ করে যা ডলারকে নিরাপদ স্থান ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অনেক সময় ডলারের মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধি হলে আমদানিকারক দেশগুলোর বাজারে এটি বেশ প্রভাব ফেলে। যেমন বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, ভারত, নাইজেরিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্ব ব্যাংক অথবা আইএমএফ থেকে ঋণ ডলারের মাধ্যমে নেয়। এতে ডলারের মূল্যের বৃদ্ধির কারনে আমদানি খরচ বৃদ্ধি, ঋনের বোঝা বেড়ে যাওয়া সহ ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর বাজারে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পরে। 

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সুদের হার বাড়ায়, তখন ডলারের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন অন্য দেশ থেকে তাদের টাকা সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায়। এর ফলে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মুদ্রার মান কমে এবং পুঁজির অভাব দেখা দেয়। এইভাবে ডলারের আধিপত্য বিস্তার হয়েছে যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। শত্রু দেশ যেমন রাশিয়া, চীন, ইরান ইত্যাদি দেশের ওপর ডলারের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারনে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পরে।

মার্কিনি ডলারের এই আধিপত্য বা পাওয়ার গেম থেকে বের হয়ে চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশ নিজস্ব মূদ্রায় ব্যবসা করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। চীন তাদের মূদ্রা ইয়ানকে বিশ্ব বাজারে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করছে। অপরদিকে রাশিয়া সৌদি আরবের সাথে রুবলের মাধ্যমে তেল বানিজ্য করার প্রয়াস অনেকদিন ধরেই করে যাচ্ছে। যদিও ডলারের স্থিতিশীলতা ও একচেটিয়া গ্রহণযেগ্যতা একে এখনও অনন্য অবস্থানে রেখেছে, তবুও অনেকেই চিন্তা করছেন যে বিটকয়েনকে বিশ্ব বানিজ্যের একক মূদ্রা হিসাবে স্থাপন করা যায় কিনা। এখন সম্ভব না হলেও অনেকেই মনে করছেন এক রাজার রাজত্ব আর কতদিন, হয়তো ক্রিপ্টো কারেন্সি ও হয়ে যেতে পারে প্রধান মূদ্রা।

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখিকা,

সিরাজুম মুনিরা  

ইন্টার্ন,

কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE