ব্লুপ্রিন্টে কারো নাম-সই নেই, কিন্তু মুসকান এই জিনিসটার মোহ কাটাতে পারল না। জটিল লাইন গুলোর উপর আঙুল বোলালো সে। মনে হলো তার, এই বাড়ি নশ্বর পৃথিবীর নাগালের বাইরে। অদৃশ্য হাত যেন মুসকানকে বলে দিলো কোথায় যেতে হবে।
সে চলে গেল পুরান ঢাকার সরু গলিতে, যেখানে দেখল বিস্মৃত স্মৃতির মতো মরচে পড়া টিনের ছাদ থেকে বৃষ্টি ঝরছে। দালানটি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল পরগাছার লতা-পাতার পর্দার আড়ালে। সেদিন সে বাতাসে ভেজা মাটির ঘ্রাণ আর গোপনীয়তার গন্ধ পেল।
মুসকানকে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে হলো। সে যেন শুনতে গেলো, দেয়ালগুলো ফিস ফিস করে কি যেন বলছে। ফ্লোরবোর্ডগুলো আর্তনাদ করে উঠলো। তারপর পর একটা ঘরে ঢুকে দেখে সে, ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা আয়না দাড়িয়ে আছে।
“স্বাগতম, ছোট্ট বন্ধু”, আয়নাটা থেকে প্রতিধ্বনির মতো সুরেলা শব্দ বের হলো, “আমি স্থপতির হয়ে কাজ করা একটা সুরঙ্গ। আমার মধ্য দিয়ে গেলে কল্পনার চেয়ে বিস্ময়কর জিনিস দেখতে পাবে তুমি।”
মুসকান ইতস্তত বোধ করল। সে ছোট্টবেলায় শুনে ছিলো এগুলোতে ভূত-প্রেত আছড় থাকে। ওদের সাথে গেলে আর ফিরে আসা হবে না। কিন্তু সে কৌতূহলকে দমাতে পারল না। ধুর! কী বা হবে, শোনা গল্প বিশ্বাস না করলে?
অতঃপর, সে আয়নাটাকে ছুয়ে দিল।
অপর পাশে, ঢাকা শহরের অদ্ভুতুড়ে এক রূপ দেখতে পেল। নিয়ন সাইনবোর্ড আর বাতি দিয়ে ভর্তি পুরো শহর। অদ্ভুভুড়ে জিনিস যেমন, অদৃশ্য হওয়ার জামাও হকাররা বিক্রি করছে। রিক্সার চাকা গুলো প্রপেলারের মতো ঘুরছে আর আকাশে ভাসছে। আর লোকজনের কথা তো বাদই যাবে।
এক দোকানদার এমন এক ধরণের পান্তা ভাত বিক্রি করছিল, যে গুলো খেলে নাকি ছন্দের সুরে কথা বলা যায়। পাশেই এক ভবঘুরে বিড়াল তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করছিলো।
মুসকান হেসে দিল। এই রকম জায়গাই সে চেয়েছিল।
কিন্তু গল্পের মোড় বদলে গেল, যখন একজন স্থপতি তার সামনে আসল। ঝীর্ণ-শীর্ণ বৃদ্ধ অথচ চোখে তার এখনও জ্যোতি আছে। সে মুসকানের হাতে একটা সেতুর ব্লুপ্রিন্ট ধরিয়ে দিলো। “এটি বানাতে পারবে?” আগ্রহের সাথে সে মুসকানকে প্রশ্ন করলো। “আর তা করলেই তুমি তোমার বাড়িতে চলে যেতে পারবে” বৃদ্ধ যোগ করলো।
আর তখনই, মুসকানেরও মনে পড়ল, বাড়িতে ফেরত যাওয়া দরকার। তারপরের পূর্ণিমার রাতে, সে সেতুটি দাড় করিয়ে ফেলল। সেতুর দুইপাশে দুই পৃথিবী দাড়িয়ে আছে। সেই পূর্ণিমায়, মুসকান সেতুর উপর হাটা শুরু করল। সে সেতুর ওপাশে তার আসল পৃথিবীটাকে দেখতে পেল।
কিন্তু হঠাৎ স্থপতি হাজির হলো, তার পথ আটকে দিলো। “দাড়াও, একটা জিনিস বাকি আছে।” “কি?” মুসকান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো। “তোমাকে একটা কৌতুক বলতে হবে।” বৃদ্ধ উত্তর দিলো।
মুসকান কিছুক্ষণ ভাবল। “আপনি কি ‘ফাইন্ডিং নিমো’ মুভিটি দেখেছেন?”
স্থপতি ভ্রু কোচকালো। “তুমি কী মনে করেছো, আমাদের এখানে থিয়েটার নেই? এখানে ভালুক, মহিষরাও আমাদের সাথে ছায়াছবি দেখতে আসে। এই ছবি দেখে বিড়াল থেকে মাছেরও পর্যন্ত চোখ ছলছল করে উঠেছিলো।”
“তাহলে মন দিয়ে শুনুন” মুসকান বলল। “আমার বাবা আর নিমোর মধ্যে সবচেয়ে কমন জিনিসটা কী জানেন?”
“কী” স্থপতির কৌতূহলে ভরা চোখদুটো যেন আরো বড় হয়ে উঠল।
“ওদের দুইজনকেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি”, মুসকান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
স্থপতি মাথা নাড়ল, “ভালো থেকো মা, ভ্রমণ শুভ হোক।”
আর মুসকান জদুময়ী ঢাকা শহরকে পেছনে ফেলে কোলাহলময় পুরুনো জীবনে ফিরে এল। কিন্তু তার হৃদয় থেকে ঐ মায়াবী হাসি আর বিস্ময়ের জগৎটা কখনোই হারিয়ে যায়নি।
আবার কখনও কখনও, যখন পূর্ণিমা হয়, তখন সে আয়নাটার দিকে তাকায় – ভাবতে থাক সে কখনও ফিরে যাবে কিনা সেই জাদুর শহরে।
এ ধরণের আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন
লেখক
সাদি রেজা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE