“মেঘনার বুকে ঝিলমিল করে,

সোনালি ইলিশ খেলে স্বরে।

নদীর ঢেউয়ে বাজে গান,

চাঁদপুর শহর প্রাণের টান।”

চোখ বন্ধ করুন, কল্পনা করুন—আপনি মেঘনার তীরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাতাসে ইলিশ মাছের মিষ্টি ঘ্রাণ, ঢেউয়ের ছন্দময় গর্জন, আর চারপাশে মানুষের প্রাণবন্ত কথোপকথন। সেই কথাগুলো যেন কোনো সুরেলা গানের মতো বয়ে যাচ্ছে আপনার কানে। চাঁদপুরের ভাষা শুধু একটি কথার মাধ্যম নয়, এটি এক ধরনের অনুভূতি। এখানকার ভাষার মিষ্টি টান, স্থানীয়দের আন্তরিকতা আর আবেগমাখা শব্দ উচ্চারণ চাঁদপুরকে করে তুলে অতুলনীয়। 

বাংলাদেশের মানচিত্রে চাঁদপুর শুধু একটি জেলা নয়, এটি একটি আবেগ, একটি ঐতিহ্য। মেঘনা, পদ্মা ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থলে গড়ে ওঠা এই শহর যেন প্রকৃতির এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। নদীর বুকে দোল খাওয়া নৌকা, মাছ ধরার জেলে, আর ইলিশের মনভোলানো ঘ্রাণ—এসব মিলে চাঁদপুর হয়ে উঠেছে এক অনন্য পরিচয়ের প্রতীক।

চাঁদপুরের ভাষার বৈশিষ্ট্য

যতবারই চাঁদপুরের রাস্তায় হাঁটবেন, ততবারই মিষ্টি ভাষার এক অন্যরকম সুর আপনার কানে বাজবে। দোকানদারের আন্তরিক ডাক, রিকশাচালকের হাসিমুখে প্রশ্ন—‘কোথায় যাইবেন?’—সবকিছুতেই একধরনের স্নিগ্ধতা মিশে থাকে। চাঁদপুরের ভাষার একটি অন্যতম বিশেষত্ব হলো এর কোমল টান।

এই ভাষার মাধুর্য হচ্ছে এর স্থানীয় শব্দ ও উচ্চারণে। ‘যাইতেছি’ শব্দের বদলে ‘যাইতাসি’, কিংবা ‘আসতেছে’ শব্দের বদলে ‘আসতাসে’ এসব শব্দে যেন একধরনের ছন্দ লুকিয়ে আছে। সাধারণ বাংলায় আমরা বলি “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”, কিন্তু চাঁদপুরের ভাষায় তা হয়ে যায় “তুমি কই যাইতাসো?”। আর সেই ছন্দের মধ্যেই ধরা দেয় চাঁদপুরের আপন সৌন্দর্য।

ইলিশ, মেঘনা ও ভাষার সংযোগ

মেঘনার তীরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কোনো মাঝির গান শোনার অভিজ্ঞতা চাঁদপুরের মানুষদের কাছে অমূল্য সম্পদ। ‘নদীর এপার কই, ওপার কই’ এমন সুরেলা কথাগুলো চাঁদপুরের ভাষার আবেগময় দিককে যেন আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে।

চাঁদপুর মানেই ইলিশ, আর ইলিশ মানেই চাঁদপুর। প্রতি বছর বর্ষাকালে যখন নদীর বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে, তখন শহর জুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। ইলিশের শহর চাঁদপুর, আর এই ইলিশের সাথে এখানকার মানুষের ভাষার এক নিবিড় সংযোগ আছে। বাজারে গেলে ইলিশ বিক্রেতাদের টানটান দরদাম, নৌকার মাঝিদের প্রাণখোলা কথা বলা সবকিছুতেই যেন একটা আন্তরিকতা থাকে। এই ভাষার মধ্যে এক ধরনের সারল্য আছে, যা চাঁদপুরের মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি।

ভাষার পরিবর্তন ও আধুনিক প্রভাব

সময়ের সাথে সাথে চাঁদপুরের ভাষাতেও পরিবর্তন এসেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকে ঢাকাইয়া উচ্চারণ রপ্ত করছে, কেউ কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। কিন্তু পুরনো দিনের গল্পগুজব, আঞ্চলিক শব্দ আর সুরেলা কথাবার্তা এখনো চাঁদপুরের অলিগলিতে বেঁচে আছে।

কিছু কিছু জায়গায় ভাষার বিবর্তন হলেও চাঁদপুরের গভীর শিকড় গাঁথা রয়েছে এর ঐতিহ্যে। নতুন ধারা এলেও, চাঁদপুরের মানুষের কথার মিষ্টি টান কখনো হারিয়ে যাবে না। যুগ বদলালেও কিছু কিছু জিনিস কখনো হারায় না, বরং আরও গভীরভাবে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। চাঁদপুরের ভাষাও তেমনই। যতদিন মেঘনার ঢেউ থাকবে, যতদিন ইলিশের সুগন্ধ বাতাসে মিশে থাকবে, ততদিন চাঁদপুরের ভাষার মাধুর্য থাকবে অটুট।

চাঁদপুরের সৌন্দর্য, ভাষার সুর আর ইলিশের স্বাদ মিলিয়ে এটি যেন এক স্বপ্নপুরী। এই শহর শুধু ভ্রমণের স্থান নয়, এটি অনুভবের জায়গা। এখানকার প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি বাতাস আর প্রতিটি মানুষের হাসি চাঁদপুরকে বিশেষ করে তোলে। এই শহরকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।

আমাদের উচিত এই ভাষাকে ভালোবাসা, সংরক্ষণ করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এর সৌন্দর্য তুলে ধরা। কারণ ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের শিকড়, আমাদের পরিচয়। যদি কখনো চাঁদপুরে যান, তাহলে নদীর ধারে বসে মেঘনার হাওয়া গায়ে মেখে দেখবেন, স্থানীয়দের কথাবার্তায় এক অন্যরকম সুর রয়েছে। এই সুর, এই ভাষার টান চাঁদপুরকে শুধু মানচিত্রের একটি জেলা নয়, বরং এক ভালোবাসার নাম করে তুলেছে।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে,এখানে ক্লিক করুন

লেখক

তন্দ্রা সাহা তনু

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE