১১ জুলাই ২০১৪-এর রাত, ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটা ছুঁয়েছে, আমরা ঢাকার সায়দাবাদ থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে আল-মোবারাকা বাসে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের গন্তব্য ছিল মেঘের দেশ মেঘালয়। রোমাঞ্চপ্রিয় ২২ জনের দলের আমি একজন। সবার মাঝে মেঘালয়ের সৌন্দর্য নিয়ে এক ধরনের অজানা কৌতূহল। আমাদের অনেকে মেঘালয়ের নাম শুনলেও সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য এই প্রথম।
ভোর ছয়টার দিকে যখন সিলেট শহরে পৌঁছাই, তখন বাইরে ঝুম বৃষ্টি। সিলেটের বিখ্যাত পানসি রেস্তোরাঁতে আমরা মুরগি-খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম। বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে স্থানীয় লেগুনাতে চললাম তামাবিল বর্ডারের দিকে। কাস্টমসের প্রক্রিয়া শেষ করে সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা ডাউকি বর্ডার পেরিয়ে ভারতের মাটিতে পা রাখলাম। নতুন দেশে নতুন এক প্রকৃতির দুনিয়া আমাদের তখন হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। ডাউকি বাজারে পৌঁছানোর পর প্রথম কাজ ছিল বাংলাদেশি টাকা থেকে ভারতীয় রুপি ভাঙ্গিয়ে নেয়া। এখানে আমরা হালকা নাস্তা করে রওনা দিলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য, উমক্রেম ফলসের দিকে।
উমক্রেম ফলসের বিশাল জলপ্রপাত দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। চারপাশের সবুজ গাছপালা আর পাহাড়ের মাঝে জলপ্রপাতের শব্দ যেন প্রকৃতির এক অপার্থিব সংগীত। এর সৌন্দর্য এতটাই আকর্ষণীয় যে চোখ সরানো যায় নয়া। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এই সৌন্দর্যকে আরও রহস্যময় করে তুলেছিল।
পরবর্তী গন্তব্য ছিল এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে পরিচিত মাওলায় নং। এ গ্রামের পরিচ্ছন্নতা এবং স্থানীয়দের জীবনযাত্রার শৃঙ্খলা অবাক করার মত। এই গ্রামের অদূরেই দেখা পেলাম বিখ্যাত লিভিং রুট ব্রিজ বা জীবন্ত সেতুর। শত শত বছর ধরে প্রকৃতি আর মানুষের চেষ্টায় সৃষ্টি এই সেতুর। নদীর উপরে থাকা এই সেতুটি একধরনের রাবার গাছের শেকড় আর ডাল দিয়ে তৈরি। বিকেল হয়ে আসছিল, মাওলায় নং গ্রামের একটি স্থানীয় হোটেলে মাছ আর স্থানীয় সবজি দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেই আমরা ।
এরপর শুরু হলো মেঘালয়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ১৫২০ মি. উচ্চতায় শিলং শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। একবার এখানে আসলে বোঝা যায় কেন মেঘালয়কে মেঘের দেশ বলা হয়। কখনো আমরা মেঘের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম, আবার কখনো উঁকি দিচ্ছিল সূর্য। রাত সাড়ে আটটার দিকে শিলং-এ আমাদের হোটেলে পৌঁছাই।
১৩ জুলাই বেশ ভোরেই আমরা রওনা দিলাম। একটি পাহাড়ি নদীর পাঁশে বসে ম্যাগি আর লুচি-তরকারি সকালের নাস্তা করলাম। আজ প্রথম গন্তব্য ছিল ওয়াকাবা ফলস। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ঘন মেঘের কারণে আমরা ফলসটির পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারিনি। তবুও আশেপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য আমাদের মনকে ভরিয়ে দেয়।
এরপর যাত্রা শুরু হলো মেঘালয়ের অন্যতম আকর্ষণ সেভেন সিস্টার ফলস এর দিকে। সেভেন সিস্টার ফলস, যার আসল নাম নোহসিংথিয়াং ফলস, ভারতের অন্যতম উঁচু জলপ্রপাত। এখানে সাতটি পৃথক ঝরনা একসাথে বয়ে চলে। জলপ্রপাতের সাতটি ধারা পরিষ্কার ভাবেই আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ১,০৩৩ ফিট উচ্চতা থেকে জলধারা নেমে আসার সৌন্দর্য সত্যিই বর্ণনাতীত। এমন একটি দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে যেন মনটা নিমেষেই প্রশান্তিতে ভরে গেল।
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল মাওসমাই গুহার দিকে, যেখানে আমাদের হাঁটার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। চুনাপাথরের এই গুহার ভিতরে আবছা অন্ধকারে হাঁটু পর্যন্ত ঠান্ডা পানিতে হাঁটার সময় কেমন এক শিহরন কাজ করছিল।
এরপর আমরা গেলাম মেঘালয়ের আরেকটি বিখ্যাত ফলস, কেনরিম ফলস। পাহাড়ের ১,০০১ ফুট উপর থেকে নেমে আসা বিশাল জলপ্রপাতটি দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। অনেকের মত আমরাঅ এখানে ঝরনার ঠাণ্ডা পানিতে গাঁ ভিজিয়ে নেই। সন্ধ্যার দিকে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম, শরীর ক্লান্ত কিন্তু মন ছিল আনন্দ আর উত্তেজনায় ভরপুর।
১৪ জুলাই ছিল আমাদের শেষ দিন। সকালের নাস্তা শেষে আমরা রওনা দিলাম লাইটরুম ক্যানিয়ন এর দিকে। এই স্থানটির সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না—এক সময় চারপাশে শুধু মেঘ আর কুয়াশা, আবার এক মুহূর্তেই ঝলমলে রোদ্দুর।
এরপর আমরা ক্রাংছড়ি ফলস এর দিকে যাত্রা করি, যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে ঝরনাটা সেদিন বন্ধ ছিল। দূর থেকেই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দুপুরের খাবার সেরে আমরা বাংলাদেশের পথে রওনা দিলাম। পথে ডাউকি বাজারের কাছে জাফলং ভিউ পয়েন্টে থেমে সবাই গোসল করেছিলাম। বিকেল চারটার দিকে ডাউকি-তামাবিল বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে প্রবেশ করি।
ডাউকি বর্ডার পার হয়ে আবার বাংলাদেশে পা রাখার সময় মনে হচ্ছিল, এই ভ্রমণ আমাদের জীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। মেঘ, বৃষ্টি, জলপ্রপাত আর পাহাড়ি সৌন্দর্যের মেঘালয় আমাদের মনে এক চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি আমাকে এ অসাধারণ ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ, যিনি আমাদেরকে তার সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছেন।
মেঘালয় ভ্রমণ ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রকৃতির অনবদ্য সৌন্দর্য আমাদের মনকে মোহিত করেছে। পাহাড়, মেঘ, জলপ্রপাত, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল মুগ্ধকর। জীবন্ত সেতু থেকে সেভেন সিস্টার ফলস, প্রতিটি জায়গায় আমরা প্রকৃতির বিশুদ্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করেছি।
এরকম আরো লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
ফারদিন বিন আব্দুল্লাহ
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE