তরুণরা প্রাণবন্ত, আত্মবিশ্বাসী, সাহসী এবং উজ্জ্বল। তরুণরা যেমন একটি জাতির ভবিষ্যৎ তেমনি জাতির বর্তমান চালিকাশক্তি। এই তরুণদের জন্য YSSE কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান ” আজকের তারুণ‍্য “। এখানে মূলত কথা বলা হয় তরুণদের সাফল্য, তাদের সংগ্রাম এবং সমাজ ও দেশের জন‍্য তাদের অবদান নিয়ে। আজকের তারুণ্য সিজন ২ এর ১৪ তম এপিসোডে হোস্ট হিসেবে ছিলেন YSSE মেম্বার  আহসান হাবিব এবং এই পর্বের বিশেষ অতিথি ছিলেন Kiban Shoe এবং Kiban Trade International এর তরুণ প্রতিষ্ঠাতা মেহেদী হাসান। তার যাত্রাপথের সূচনা, কাজ অব‍্যাহত রাখার প্রেরণা, অভিজ্ঞতা এবং  অসাধারণ হয়ে  ওঠার গল্পগুলো নিয়ে মূলত আজকের আয়োজন। চলুন শুরু করা যাক।

প্রশ্ন: আপনার সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্পগুলো যদি বলতেন আমাদের।

আমি মেহেদী হাসান ২০১৭ সালের মে মাসে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর স্নাতক শেষ করেছি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে ব‍্যবসায়ের বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত থাকার কারণে ব‍্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল। এই আগ্রহ থেকেই জব করার ইচ্ছা বা প্রিপারেশন ছিল না। ২০১৮ সালের  শেষের দিকে Facebook মার্কেট প্লেসে একটি ঘড়ি সেল করার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করি। আলহামদুলিল্লাহ্ বর্তমানে Kiban Shoe, Kiban Trade International এবং Marketing Agency তিনটি প্রতিষ্ঠান সমান্তরাল ভাবে চলছে।

প্রশ্ন:  আপনি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিলেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার থেকে সফল বিজনেসম‍্যান হওয়ার মূল প্রেরণা কোথায় পেয়েছিলেন যদি শেয়ার করতেন।

ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে বিজনেসের বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত থাকার কারণেই বিজনেস করার একটি মোটিভেশন পরবর্তীতে তৈরি হয়। কুয়েটের শেষ বর্ষে এসে MBA করার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ পায়। North South ইউনিভার্সিটি থেকে MBA শেষ করি। কুয়েট আসোসিয়েশনের VP হওয়ার কারনে ইভেন্টের জন্য অনেক উচ্চপর্যায়ের মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়, সবাইকে নিয়ে কাজের সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে নিজের লিডারশিপ স্কিল নতুন করে  আবিষ্কার করি। বিজনেসে আসার এটিও অন‍্যতম কারণ। টিউশনের ২৫০০০ টাকা নিয়ে আমার বিজনেস শুরু করি। সেই ছোট স্বপ্ন এখন এত বড় পরিসর হয়েছে যে বতর্মানে তার ১০℅ ও করতে পারি নি বলে মনে হয়।

প্রশ্ন: ব‍্যবসার ইনভেস্টমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আপনার  ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল কিংবা আপনার প্রাথমিক  ইনভেস্টমেন্ট কিভাবে ম‍্যানেজ করেছিলেন?

ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ে কথা বলার আগে  আরো  কিছু বিষয়ে কথা বলতে হয়। আমার মনে হয়  ইনভেস্টমেন্ট দুই রকম। মানসিক ও আর্থিক। অল্প ইনভেস্টমেন্ট দিয়েও নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করা যায়। আমি শুরুর দিকে ৫ টাকার ব‍্যবসা করে ২০ টাকার জ্ঞান অর্জন করেছি।

বতর্মানে তরুণরা অর্থ উপার্জন করাই বিজনেসের মুল লক্ষ্য মনে করে। তাই কাঙ্খিত ফলাফল না পেলে বিষন্নতায় ভুগছেন। কিন্তু দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ব‍্যবসাকে এক পর্যায়ে স্থিতিশীল করে। আমার ব‍্যবসা যখন কিছুটা স্থিতিশীল পর্যায়ে তখন কুয়েটের এক বড় ভাই ৬ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করেন। এটাই আমার ব‍্যবসার প্রথম ইনভেস্টমেন্ট। এরপর থেকে বিজনেস আরও বড় হতে থাকে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের টপ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বিজনেস শুরু করায় সামাজিক কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল কি?

নিজের ফ‍্যামিলি হতে শুরু করে  আত্মীয়স্বজন সবাই অনেক কথা বলেছেন। আমি এতো ভালো  ব‍্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেও বিসিএস কেন দিচ্ছি না। অপমানজনক কথাও শুনতে হয়েছে। খারাপ লাগে নি ব‍্যাপারটি এমন না। কিন্তু খারাপ লাগাটাকে প্রশ্রয় দেইনি। মানুষ থাকলে কথা হবেই এক সময় বাড়ি যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্য পূরণের জন্য চেষ্টা করে গেছি। ফলাফল স্বরূপ আজ আমি  এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।

প্রশ্ন: ব‍্যবসায় দেখা যায় পরপর লোকসান হয়। তখন  উদ‍্যোগতারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সমস্যাগুলো মোকাবেলা করে ব‍্যবসায় ধারাবাহিকতা রাখতে উদ‍্যোগতারা কি করতে পারেন?

ব‍্যবসায় লোকসান হলে বুঝতে হবে পরিকল্পনায় মৌলিক কিছু ভুল রয়েছে। ভুল গুলো খুজে বার করতে হবে প্রথমে। সমস্যার সমাধান কোথায় পাওয়া যাবে সেটিও খুজতে হবে। মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। শ্রম দিলে অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে কিন্তু আপনার ব‍্যবসার সম্পর্কে ধারণা না থাকলে লোকসান গুনতে হয়। ব‍্যবসা শুরু করতে হবে এমন প্রোডাক্ট নিয়ে যেটি আপনি ১০০ ভাগ বিক্রি করতে পারবেন। ধাপে ধাপে ব‍্যবসার পরিসর প্রতিষ্ঠানকে স্থিতিশীল করে। দ্বিতীয়তো উৎসাহ ধরে রাখার জন্য এমন মানুষদের সাথেই আমাদের চলা উচিৎ যারা মানসিকভাবে আমাদের উৎসাহ দেয়। যারা নিজেদের জীবনে বিষন্নতায় ভুগছেন তাদের সমন্বয় থাকলে আপনারও মানসিকতার উপর প‍্রভাব পরতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা সেল করা শিখতে হবে। আপনি অনেক মানসম্মত প্রোডাক্ট প্রোডাকশন করেন কিন্তু কিভাবে সেল করতে হয় জানেন না। তাহলে ব‍্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পরাই স্বাভাবিক। শ্রম, মেধা দিয়ে লেগে থাকলে ব‍্যবসায় সফলতা নিশ্চিত আসবে।

প্রশ্ন: Kiban Shoe নামেকরণের গল্পটি কেমন ছিল?

Kiban নামকরণের গল্পটা আসলেই অনেক মজাদার। আমার অনেক বিষয়ে অলসতা কাজ করে তেমনি নামকরণের সময়  অলসতা কাজ করেছিল। আমি কিছু নাম আমার বন্ধুদের দিয়েছিলাম সেখানে সবাই আলাদা মতামত দিচ্ছিল। তখন কুয়েটের এক ছোট ভাই আমার পাশে বসে ছিল। আমি বগুড়ার ছেলে। বগুড়ায় “কি জানি” কে “কি ব‍্যান” বলে। আমি বারবার বলছিলাম কি ব‍্যান নাম দিব। তখন সেই ছোট ভাই কি ব‍্যান কে ইংরেজিতে লিখল “KIBAN” তখনই  আমি বললাম এই নামই রাখবো। অনেকে মনে করেন আমার নাম কিবান আবার আমি চায়না থেকে মাল ইম্পোর্ট করি তাই হয়তো ভাবেন আমি চায়নার কোন শব্দ ব‍্যবহার করেছি। কিন্তু নামটি আমার  আঞ্চলিক ভাষা থেকে নেওয়া।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে অসংখ্য shoe brand রয়েছে। সেখান থেকে আপনি Kiban এর জন‍্য মানুষের বিশ্বাস কিভাবে অর্জন করেছেন?

আমি যখন বাটা বা এপেক্স নিয়ে রিসার্চ করছিলাম তখন একটি বিষয় খেয়াল করলাম জুতার ডিজাইনে কোনো নতুনত্ব নেই। পুরনো ডিজাইনের জুতা গুলিই এখনো বিক্রি হচ্ছে। আমি চেয়েছিলাম নতুনত্ব আনতে। যেটা চায়নায় সম্ভব ছিল। আমি চায়না থেকে ইম্পোর্ট শুরু করে দিলাম। আমার মনে হয় নতুনত্ব আর সঠিক প্রাইস নির্ধারণ করার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে Kiban তার জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে ইম্পোর্ট এর পাশাপাশি দেশীয় প্রোডাকশন ও করছি  আমরা।

প্রশ্ন: বর্তমানে সরকার পরিবর্তন ও করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা আপনাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?

করোনা পরবর্তী ডলার রেট ও আমাদানি অতিরিক্ত ভ‍্যাট সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু মানুষের চাহিদা, সমস্যা কাটিয়ে  উঠতে  অনেকাংশে সাহায্য করেছে। তাছাড়াও আমি  আমার  আর্নিং সোর্স একজায়গায় স্থির রাখিনি। বৈচিত্র্য থাকার কারণে  এক জায়গা লোকসান হলেও  আমার জন্য  আরেকটি উন্মক্ত থাকবে। মূলত এই সমাধান গুলোর কারনেই  আর্থিক মন্দা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি।

প্রশ্ন: যারা নতুন ব‍্যবসা করতে চায় তাদের জন‍্য যদি কিছু পরামর্শ দিতেন?

ব‍্যবসার মাইন্ডসেট প্রথমে ঠিক করা। ভবিষ্যতে বড় কিছু করার চিন্তা থাকলে বর্তমানে যা আছে, আমার আয়ত্তের ভিতরে তা দিয়ে শুরু করে দেওেয়া। অনেকেই দেখা যায় কিছু দিন চাকরি করে ব‍্যবসার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু আমি বলবো ব‍্যবসার জন‍্যই আপনি প্রথম  এক দুই বছর ব‍্যয় করেন।

র‍্যাপিড ফায়ার রাউন্ড :

প্রশ্ন: এমন একটি স্কিল যা প্রত‍্যেক উদ‍্যোগতাদের থাকা  উচিত বলে  আপনি মনে করেন?

উ: ডেডিকেশন আর কারেজ।

প্রশ্ন: আপনার প্ল‍্যান A ছিল মূলত বিজনেস। আপনার প্ল‍্যান B কি ছিল?

উ: আমার প্ল‍্যান B ছিল না। A,B সব বিজনেস ছিল।

প্রশ্ন:  আপনার অবসার সময়ে আপনি করতে পছন্দ করেন?

উ: বন্ধুদের সাথে আড্ডা।

প্রশ্ন: যদি টাইম ট্রাভেল থাকে তাহলে অতীতে যেয়ে নিজেকে কি পরামর্শ দিবেন?

 উ:  আরো এক বছর  আগে ব‍্যবসা শুরু করতে বলতাম।

প্রশ্ন: আপনি কি ধরনের জুতা পছন্দ করেন?

উ: Casual

প্রশ্ন: আপনি বিজি লাইফ থেকে রিফ্রেশমেন্ট নিয়ে থাকেন কিভাবে?

উ:  আমার ট্যুর দিতে ভালো লাগে। আগে দেশেই ঘুরতাম। এখন সামর্থ থাকার কারণে বিদেশেও ট্যুর দিতে পারি।

প্রশ্ন: স্টুডেন্ট লাইফের কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি মিস করেন?

উ: হল লাইফ

লাস্ট প্রশ্ন: আপনার সফলতার পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?

উ: আমার বাবা। 

মেহেদী হাসান – আমার নতুন বা পুরাতন উদ‍্যোক্তাদের জন‍্য কিছু কথা ছিল – লাভ বা ক্ষতির কথা না ভেবে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ঠিক করুন। প্রক্রিয়াটাকে উপভোগ করুন। ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মেহেদী ভাই। আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের দর্শকদের অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকেই  আছেন যারা ব‍্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন কিন্তু সঠিক দিক নির্দেশনা পাচ্ছেন না তাদের জন‍্য আজকের  এপিসোড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা আশা করি, Kiban Shoes খুব শিগগিরই সারা দেশে পরিচিত একটি ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে।

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখিকা

আনিকা শারমিলা

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE