বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন ষাট গম্বুজ মসজিদ। বিশ্বজুড়ে এই মসজিদের অনেক সুপরিচিত রয়েছে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, নান্দনিক নির্মাণশৈলী ও সংস্কৃতি জন্য। প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এ মসজিদ যা বাংলাদেশের গর্বের অন্যতম প্রতীক।
ষাট গম্বুজ মসজিদের ছাদের ওপর অনেকগুলো গম্বুজ রয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী গম্বুজের সংখ্যা প্রায় ষাট হওয়ায় এই মসজিদের নামকরণ হয় ‘ষাট গম্বুজ মসজিদ’। যদিও মসজিদটির গম্বুজ সংখ্যা ষাটের বেশি তবুও ঐতিহ্যবাহীভাবে এ নামেই পরিচিত।তাছাড়া মসজিদটি বিশাল আকৃতির ইট ও পাথরের তৈরি স্থাপনা, যা আয়তাকার নকশায় নির্মিত। মসজিদের ছাদে রয়েছে ৭৭টি ছোট গম্বুজ এবং কিনারায় চারটি বড় গম্বুজ। ভেতরে রয়েছে ১১টি প্রবেশপথ এবং ৭টি খিলান সারি রয়েছে এর মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে মসজিদটিকে আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে চুন, সুরকি, কালো পাথর ও ছোট ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা প্রায় ৮১টি। আছে খানজাহানের দিঘির ঐতিহ্যবাহী ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ কুমিরের মমি। ওপরে বা ছাদে ওঠার জন্য দুইটি সিঁড়ি আছে তার দক্ষিণ পূর্ব দিকটির নাম রওশন কোঠা উত্তর-পূর্বটির দিকটির নাম আন্ধার কোঠা। মসজিদের ভেতরের স্থম্ভগুলো ইটের তৈরি এবং এগুলো গম্বুজগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে। দেয়াল ও খিলানে জটিল নকশাকৃত কারুকাজ দেখা যায়, যা তৎকালীন মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল উদাহরণ। মসজিদটির নির্মাণে আভিজাত্য ও প্রতিরক্ষার নিদর্শন মিলিত হয়েছে। প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের সুব্যবস্থা এবং স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য একে অতুলনীয় করে তুলেছে।
শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন ষাট গম্বুজ মসজিদ। প্রাচীন এই নিদর্শনের জন্য বাগেরহাটকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়ায় এর পরিবেশ সবসময় মনোরম, স্নিগ্ধ ও শান্ত।
খান জাহান আলী পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়কালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলার একজন বিখ্যাত সুফি সাধক ও প্রশাসক। ঐই আমলে মসজিদটি শুধু নামাজ আদায়ের জন্য নয় বরং প্রতিরক্ষার জন্যও ব্যবহৃত হত। ইট ও পাথরের সমন্বয়ে নির্মিত এই স্থাপত্যে মধ্যযুগীয় মুসলিম শিল্পরীতির অপূর্ব এক উদাহরণ । মসজিদটির ইতিহাস আমাদের মুসলিম শাসনামলের স্থায়ী স্মৃতি বহন করে। মসজিদের বিশেষত্ব হলো এর বিশাল আকৃতি, বহু গম্বুজের সমন্বয়, শক্ত নির্মাণশৈলী এবং দেয়ালের মনমুগ্ধকর সূক্ষ্ম কারুকাজ। এটি একদিকে যেমন প্রার্থনার স্থান, অন্যদিকে তেমনি একটি দুর্গের ভূমিকাও পালন করতো।
মুসলিম শাসনামলের মসজিদ স্থাপত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এটি খান জাহান আলীর সময়কালের সমৃদ্ধ শহর বাগেরহাটের ইতিহাস বহন করে। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। বাংলার মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে এটি ইতিহাসে উজ্জ্বল স্থান পেয়েছে। প্রতিবছর এ মসজিদটিতে দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধলাখ মুসল্লি পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করে থাকে।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা প্রতি বছর এখানে আসে।এই মসজিদ ধর্মীয় ও স্থাপত্য দুই দিক থেকেই মূল্যবান। এই নিদর্শনকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানা মেলা ও ওরস। এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে এই মসজিদের গভীর সংযোগ রয়েছে। বিশেষকরে, ওরস উপলক্ষে হাজারো মানুষ ভিড় জমায় যা পরিবেশকে আনন্দময় ও উৎসবমুখোর করে তোলে । মসজিদটির আশেপাশে খান জাহান আলীর মাজার, গোদা নদী এবং আরও কিছু প্রাচীন স্থাপনা অবস্থান করছে । এর সবুজ প্রান্তর ও শান্ত পরিবেশ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে, যা ইতিহাস ও প্রকৃতির অপূর্ব মিলবন্ধন।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ষাট গম্বুজ মসজিদ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। বিশেষ নামাজের সময় কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সরকারি ছুটির দিনেও এটি খোলা থাকে এবং নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে ভ্রমণ করা হয়।
ষাট গম্বুজ মসজিদের ইতিহাস, ধর্ম এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব যুগ যুগ ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে আসছে। ঐতিহাসিক মসজিদটি যেন স্থাপত্য জ্ঞান, শিল্পচর্চা ও ঐতিহ্যের গৌরবময় এক দৃষ্টান্ত। যা বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে জানতে সাহায্য করে।এই মসজিদ প্রমাণ করে আমাদের দেশ কত সমৃদ্ধ ছিল স্থাপত্যশিল্পে। আমাদের এই মূল্যবান ঐতিহ্য সংরক্ষণে সকলে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাই প্রয়োজন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজ। স্কুল-কলেজেও এর ইতিহাস শেখানো দরকার। পর্যটন ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার বাড়াতে হবে। স্থানীয় জনগণকে ঐতিহ্য রক্ষায় সম্পৃক্ত করা উচিত।আমাদের মনে রাখতে হবে ঐতিহাসিক চেতনাকে জাগ্রত করতে ষাট গম্বুজ মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
মোছা: জান্নাতুল ফেরদৌসী রিচি
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE