মনে আছে ফকির আলমগীরের সেই গানের কথা? 

“ও সখিনা গেচোস কিনা ভুইলা আমারে, আমি এখন রিকশা চালাই ঢাকা শহরে”

৮০ দশকের এই বিখ্যাত গান যেন নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রিকশা চালক ও রিকশাকে । 

কিন্তু প্রতিদিন ধুলোমাখা পথে যে রিকশাগুলো ছড়িয়ে থাকে এদিক সেদিক তার পেছন দিকটায় কখনো তাকিয়ে দেখেছেন কি? ঐ যে রঙ-বেরঙের ছবি আঁকা আয়তাকার পাতগুলো, ঐ যে রিকশা সাজিয়েছে ওরা বহু কারুকাজে- ওগুলোই রিকশাচিত্র বা রিকশা আর্ট। মনে হয় যেন এক চলন্ত ক্যানভাস! 

রিকশার পেছনে সেই আর্টগুলোকে খুব শিল্প মন দিয়ে দেখার অবকাশ হয়তো বা আমার আপনার কারোর ই নেই!   ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে , চোখে পড়ে কিন্তু মনে ধরার সময় থাকে না! ঠিক  এমনই অবস্থা আজ আমাদের দেশের রিকশা আর্টের। 

পথযাত্রীদের প্রতিদিনের অলক্ষ্যে, রিকশাচালকদের প্রতিদিনের ঘামে খুব বিশ্বস্ত একটি সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে- ‘রিকশা আর্ট’

এবার একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক রিকশা ও রিকশা চিত্র নিয়ে! 

রিকশা চিত্র বা আর্ট কী?

রিকশা চিত্র যেন এক বহমান ঐতিহ্য! রিক্সার চাকাগুলো ঘোড়ার সাথে সাথে ইশা আরটো যেন বয়ে চলছে পরম্পরা ধরে।   নব্য রোমান্টিকতার একটি ধারা হয়ে রিকশা আর্ট জন্ম নিয়েছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে। খুব কঠিন করে ‘ত্রিচক্রযানচিত্র’ও বলা চলে, কিন্তু সবসময় সবকিছুর বাংলাটা তো আর চলে আসে না ভাষায়। তাই ঐ ‘রিকশা আর্ট’-ই অপেক্ষাকৃত পরিচিত নাম।

রিকশাচিত্র ঠিক কোন ধরনের চিত্রকর্ম?  

প্রশ্নটা ঠিক সহজ হলেও উত্তরটা এতটা সহজ নয়। কারণ  এর নিজস্ব একটি স্বাতন্ত্র্য থাকার পরও রিকশা আর্ট চিত্রকর্মের ঠিক কোন অংশের সদস্য সে সম্পর্কে কোনো হদিস নেই।  

তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিক তার ‘বাংলাদেশি আর্টস অফ দ্য রিকশা’ প্রবন্ধে এর অলঙ্করণ নিয়ে আলোচনা করেন ও নিজেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজেন এবং শেষ পর্যন্ত রিকশা আর্টের মধ্যে মিশে থাকা বহুমুখী জীবনকে উপলব্ধি করে একে আর তিনি একমুখী ছাঁচে ফেলতে পারলেন না। ‘গণমানুষের চিত্র’– এই বলেই রিকশা আর্টকে অভিহিত করেন তিনি।

অঞ্চলভেদে  রিকশা আর্টের ভিন্নতা কেমন? 

যে অঞ্চলের রিকশা, সে অঞ্চলের মত-বিশ্বাস-জীবনযাপন এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে রিকশা আর্টেও। এটি যেহেতু রিকশা মালিকের ইচ্ছেমতন ঠিক হয়, সেহেতু রিকশা মালিক বাংলাদেশের কোন অঞ্চল থেকে এসেছেন সেটি অবশ্যই তার রিকশার পেছনে থাকা ছবিতে প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাস, সামাজিক চিত্র, ধর্মীয় মতাদর্শ সবমিলিয়ে রিকশা আর্টের রকমফের নির্ধারিত হয়। কখনো তাই বাঘ-সিংহ-হাতি-ময়ুর হয়ে ওঠে রিকশা আর্টের চরিত্র তো কখনো বা শুধুই রঙ-বেরঙের লতাপাতায় ছেয়ে ওঠে এই নাগরিক শিল্প। সিনেমহলের বেশ ভালো চলাফেরা রয়েছে রিকশা আর্টে! নামকরা নায়ক-নায়িকা বা সিনেমার পোস্টারের ছবি এঁকে সিনেমার রঙে রাঙানো রিকশা আর্টও কম নেই বাংলাদেশের পথে-ঘাটে।

তবে আমরা কি জানি রিকশা কিভাবে আসলো এই বঙ্গদেশে?  

পালকির বিকল্প হিসেবে ১৮৬৫-৬৯ প্রথম কে এর উদ্ভাবন করেছিলেন, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। রিকশা তার উৎপত্তি ক্ষেত্র জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।  তবে, উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হলো, জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি ১৮৬৯ সালে যিনি জাপানে থাকতেন রিকশা উদ্ভাবন করেন।১৯০০ সালে কলকাতায় হাতে টানা রিকশা চালু হয়, তবে মালপত্র বহনের জন্য। ১৯১৪ সালে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ততদিনে মিয়ানমারের রেঙ্গুনেও রিকশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে রিকশা আসে চট্টগ্রামে। তবে ঢাকায় রিকশা চট্টগ্রাম থেকে আসেনি; এসেছে কলকাতা থেকে। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশা আনেন। রিকশার বহুল ব্যবহার এবং নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর কারণে ঢাকাকে বিশ্বের রিকশার রাজধানী বলে থাকেন অনেকে।

তাহলে রিকশা আর্টের সূত্রপাত কোথায়? 

মূলত রিকশা পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত হয় এই সময় থেকেই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে রিকশা পেইন্টিং তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে থাকে। রিকশা পেইন্টিংয়ের চাহিদা ছিল তখন অনেক বেশি। রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা তাদের অনেকে আগের পেশা বা পৈতৃক পেশা ছেড়ে এই পেশায় যুক্ত হন। 

জামদানি বয়নশিল্প, শীতলপাটি বয়নশিল্প, বাউল গান ও মঙ্গল শোভাযাত্রার পর প্রায় ছয় বছরের বিরতিতে বাংলাদেশের পঞ্চম অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে ‘ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র’ এ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে।   

কেমন আছেন রিকশা  শিল্পীরা? 

কম পারিশ্রমিক , চাহিদা কম, ভালো জীবিকার  সন্ধান এরকম আরো নানা কারণের জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন শিল্পীরা। যেখানে নিজের পেট চালানো যায় সেখানে শিল্প কর্মের সাথে জড়িত থাকা তো বিলাসিতা এরকমটাই মনে করছেন রিসার্টের সাথে জড়িত শিল্পীরা। কম পারিশ্রমিক পেয়ে এবং চাহিদা কমে যাবার জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন শিল্পীরা।  হয়তো খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের, বিশেষ করে এর রাজধানী ঢাকার বহমান ঐতিহ্যের একটি বিশেষ অংশ- ‘রিকশা আর্ট’ বিলুপ্ত হয়ে যাবে শিল্প ও শিল্পীর প্রতি অবহেলার খাতিরে।

তবে কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে রিকশা আর্ট?

বর্তমানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তবে তা সরকারিভাবে নয়, কিছুটা ব্যক্তিগতভাবে। ‘Rickshaw art in Bangladesh’ নামে একটি ওয়েবসাইট একটি রিকশা আর্টের বিক্রয়ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে। এতে একেকটি ছবির দাম রাখা হয়েছে আকারভেদে ইউএস ডলার ৮০/১০০/২০০ এরকম, যা প্রচলিত মূল্যের চাইতে অনেক বেশি। এটি মূলত রিকশা আর্টকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে এবং শিল্পীদের ভালো অঙ্কের টাকা আয় করানোর উদ্দেশ্যে চালু হয়েছে।  অভিজাত নয় লোকজ কিংবা গ্রামীণ নয়, রিকশা আর্ট মিশে আছে নাগরিক জীবনের সাথে, এটি আদতেই নাগরিক শিল্প। কিন্তু নাগরিক জীবনও কি লোকজ সংস্কৃতির বাইরের কিছু?

সর্বোপরি বলতে চাই, শিল্প বেঁচে থাকুক, পথে-ঘাটে চলতে চলতে পুনরায় বেঁচে উঠুক রঙে রাঙানো রিকশা আর্টও!

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক  করুন এখানে

লেখক

মাফরুহা  সুমাইয়া

ইন্টার্ন , কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE