ক্যালিগ্রাফিকে শুধু শিল্প নয়, বরং এক জীবনের সাধনা হিসেবে যিনি দেখেন, আজ আমরা কথা বলেছি তেমনই এক মানুষ, উসামা হকের সঙ্গে। গাজীপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে অনলাইন একাডেমি তাঁর যাত্রা যেমন অনুপ্রেরণামূলক, তেমনি আন্তরিকতায় ভরা। শিল্পচর্চা, অধ্যবসায় আর স্বপ্ন দেখার সাহস কিভাবে একজনকে গড়ে তোলে, সেই গল্পই উঠে এসেছে আমাদের এই প্রাণবন্ত আলাপে।
YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, বর্তমানে কী কাজ করছেন ইত্যাদি।
উসামা হক: আমার জন্ম গাজীপুরে। সেখানেই পড়াশোনা শুরু, তবে সাত বছর বয়সে মাদ্রাসায় ভর্তি হই এবং হোস্টেলে চলে যাই। সেই মাদ্রাসায় ১৩ বছর ছিলাম সেখান থেকেই দাখিল ও আলিম সম্পন্ন করি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবিতে অনার্স ও মাস্টার্স করি। পাশাপাশি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল ও কামিল শেষ করি। বর্তমানে আমি পেশাদারভাবে ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করছি এবং ক্যালিগ্রাফি শেখানোর কোর্স পরিচালনা করছি।
YSSE: ক্যালিগ্রাফির প্রতি আপনার আগ্রহ কীভাবে শুরু হয়েছিল?
উসামা হক: ছোটবেলা থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি আগ্রহ ছিল। মাদ্রাসার কারিকুলামে অতিরিক্ত বিষয়ে আর্ট, বক্তৃতা, সাধারণ জ্ঞান, বিতর্ক, সুন্দর হাতের লেখা ও কেরাত ছিল আমি আর্ট সিলেক্ট করি। আমাদের এক বড় ভাই ক্যালিগ্রাফি শিখাতেন, সেখান থেকেই শেখা শুরু। তখন ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্যালেন্ডারে ক্যালিগ্রাফির ডিজাইন দেখে আগ্রহ বাড়ে। ২০০৫ সাল থেকেই শেখা শুরু, তখন ভাবিনি এটিকে প্রফেশন হিসেবে নেব। পরে অনেক দিন শেখার অভিজ্ঞতা থেকে এটিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
YSSE: “Usama’s Calligraphy Academy” প্রতিষ্ঠার পেছনের অনুপ্রেরণা কী ছিল?
উসামা হক: যেহেতু ২০০৫ সাল থেকে ক্যালিগ্রাফির সাথে যুক্ত আছি, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, দেখি সেখানে অনেক ধরনের অর্গানাইজেশন রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি যেহেতু আরবিক ডিপার্টমেন্টে ছিলাম, খেয়াল করলাম আমি ছাড়া আমার ডিপার্টমেন্টে কেউ তেমন ক্যালিগ্রাফি জানে না। সেখান থেকে আমার মনে হলো আমি ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এগোতে পারি।
আমি যখন ক্যালিগ্রাফি নিয়ে আগানো শুরু করলাম, তখন প্রথমে এটি শেখানো বা একাডেমিকভাবে চিন্তা করিনি। আমাকে অনেকেই বলতেন শেখানোর জন্য, কিন্তু আমি নিজেই তখন শিখছিলাম, প্রফেশনালি আগ্রহী ছিলাম না, তাই শেখানো হয়ে উঠত না।
করোনার সময় ২০২০ সালে সবাই বাসায় বন্দি ছিলাম, তখন অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখলাম, ১০-১২ জন আছেন যারা শিখতে চান। এরপর থেকে আমি ব্যাচভিত্তিক শেখানো শুরু করি। পরে দেখি, শিক্ষার্থীরাই নিজেরা ২-৩টি ব্যাচ তৈরি করে ফেলেছে, আমাকে ক্লাস নেওয়ার কথা বলছে। এরপর যখন দেখলাম শিক্ষার্থী আসছে, তখন চতুর্থ ব্যাচ থেকে আমি নিজেই শেখানোর প্রক্রিয়া ও আয়োজন শুরু করি।
এই পর্যায়ে আমি একটি সমস্যা লক্ষ করি ক্যালিগ্রাফি বাংলাদেশে অনেকটাই মাদ্রাসা রিলেটেড সাবজেক্ট হিসেবে থেকে গেছে। জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের যারা আছেন, তারা আরবি ভাষাকে ভয় পান। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও, অনেকেই আরবি জানি না।
আমি যেহেতু মাদ্রাসা এবং ভার্সিটি উভয় লাইনে পড়াশোনা করেছি, আমার কাছে যারা ক্যালিগ্রাফি শিখতেন, তারা মাদ্রাসা ও জেনারেল দুই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই ছিলেন। মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডে শেখানোর জন্য অনেকেই আছেন, কিন্তু আমার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছিলেন জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের, যারা আরবি জানতেন না। তারা দিধায় থাকতেন তারা ক্যালিগ্রাফি শিখতে পারবেন কি না।
তখন আমি চিন্তা করলাম বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি এমনভাবে শুরু করতে হবে, যেখানে মাদ্রাসা ও জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ড দুজনেই, যারা আরবি জানেন না তারাও যেন সহজে ক্যালিগ্রাফি শিখতে পারেন। সেই অনুযায়ী একটি পদ্ধতির কথা ভাবি, যাতে জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি সহজ করে উপস্থাপন করা যায়।
যেহেতু ইতিমধ্যে অনেকগুলো ব্যাচ শেষ হয়েছে, এরপর আমি মূলত অনলাইনে একাডেমি হিসেবে এটিকে প্রকাশ করি। পরে আমার কোর্সগুলো একাডেমির আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ্, এখন আমার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের। আমরা বর্তমানে ৬০তম ব্যাচে পৌঁছেছি।
YSSE: একজন নতুন শিক্ষার্থী ক্যালিগ্রাফিতে দক্ষ হতে কত সময় নিতে পারে?
উসামা হক: যদি কেউ এটিকে শিল্প হিসেবে দেখে চর্চা করতে চায়, তবে কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে বেসিক শেখার জন্য ৫–৬ মাস যথেষ্ট। আর ২–৩ বছর ধারাবাহিক চর্চা করলে ক্যালিগ্রাফি শিল্পে ভালোভাবে আগানো সম্ভব।
YSSE: ক্যালিগ্রাফি শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী? আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করেছিলেন?
উসামা হক: ক্যালিগ্রাফি শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলি ক্যালিগ্রাফি শুরু করে টিকে থাকা। কারণ, বাংলাদেশকে আমরা একটি মধ্যম আয়ের দেশ বলতে পারি। এ ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফি-সংক্রান্ত আর্ট চর্চার জন্য যে মেটেরিয়ালস ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর মূল্য তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। তাই সব পরিবারে তা বহন করার মতো সামর্থ্য থাকে না।
তাই আমার কাছে মনে হয়, ক্যালিগ্রাফি শুরু করে টিকে থাকাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এবং খরচ করে নিয়মিত চর্চা করাটাই আসলে কঠিন। আমি আমার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দেখেছি, বাসা থেকে অনেকে খরচ দিতে চায় না। কারণ, তাদের প্রশ্ন থাকে—“এটি করে কী হবে?”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্যালিগ্রাফি চর্চা করে কী হবে, এ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। কারণ এখানে যেহেতু অনেক টাকা খরচ হচ্ছে, পরবর্তীতে এর ফিডব্যাক কেমন হবে সেটাও নিশ্চিত নয়।
অনেকেই এটিকে শখের জায়গা থেকে শিখতে পারে, কিন্তু সবাই যে এটিকে প্রফেশন হিসেবে নেবে, তা নয়। তাই শেখার আগ্রহকে ধরে রেখে চর্চা চালিয়ে যাওয়াটাই হলো মূল চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
YSSE: আপনার সফলতার পেছনে ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে কাদের সহযোগিতা আপনি উল্লেখ করতে চান?
উসামা হক: আমি একটু আগে যে চ্যালেঞ্জের কথা বললাম, এক্ষেত্রে আমার পরিবার; বিশেষ করে আমার বাবা। যখনই আমার আর্ট মেটেরিয়ালস প্রয়োজন হতো আমার কাজের ক্ষেত্রে, ছোটবেলা থেকেই, কখনো আমাকে নিরুৎসাহিত করা হতো না। বিশেষ করে আমার বাবা এই কাজগুলো অনেক পছন্দ করতেন। মানুষের কাছেও গল্প করতেন আমার ক্যালিগ্রাফি নিয়ে। আমার সফলতার পেছনে আমার বাবার সাপোর্ট অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া আমার প্রথম শিক্ষক, আমার বড় ভাই আহমেদ রেজা ফারুকী ভাই; ওনার হাত ধরেই আমার ক্যালিগ্রাফি শেখা শুরু। ওনার অবদান আমি সবচেয়ে বেশি বলব, কারণ আমি যেকোনো সময় তার কাছে গিয়েছি , এই বিষয়ে সবসময় সাপোর্ট পেয়েছি।
এরপর আমার আরেক শিক্ষক নেসারুদ্দিন ইসলাম জামিল স্যার; তার কাছ থেকেও আমি অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। আব্দুর রহিম স্যার থেকেও পেয়েছি।
সর্বশেষ, এখনো যার থেকে সাহায্য পেয়ে থাকি, তিনি আমার শিক্ষক, শিল্পী মাহবুব মুর্শিদ স্যার। ওনার কাছেও আমি অনেক বেশি ঋণী। এই দিক থেকে ক্যালিগ্রাফিকে প্রফেশন হিসেবে নেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট আমি পেয়েছি তার থেকেই।
পাশাপাশি আমার সহধর্মিণী থেকে প্রতিনিয়ত সাপোর্ট পাচ্ছি। বাংলাদেশের মতো একটি জায়গায় ক্যালিগ্রাফিকে প্রফেশন হিসেবে নিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি এই ক্ষেত্রে আমার ওয়াইফ প্রতিনিয়ত আমাকে সাপোর্ট করে যাচ্ছে। তার সাপোর্ট ছাড়া আমি এখন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারতাম না।
YSSE: আপনার এই উদ্যোগ এবং কাজের জন্য যদি কোনো স্লোগান লিখতে বলা হয় সেটি কী হবে?
উসামা হক: কালের কণ্ঠে ২০২০ সালে শফিকুর রহমান ভাই আমার ওপর একটা রিপোর্ট করেছিলেন, শিরোনাম ছিল “উসামা শব্দ আকে”—এই লাইনটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।
উসামা হকের সঙ্গে এই আলাপের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অনুপ্রেরণামূলক। একজন শিল্পী হিসেবে তার পথচলা যেমন অধ্যবসায় আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, তেমনি একজন শিক্ষক হিসেবে তার লক্ষ্যও স্পষ্ট; এই শিল্প যেন সবার কাছে সহজবোধ্য হয়, সহজলভ্য হয়।
ক্যালিগ্রাফিকে ঘিরে তার ভাবনা, সংগ্রাম, শিক্ষাদান, পরিবার ও শিক্ষকদের অবদান; সবকিছু মিলিয়ে এটি শুধু একজন শিল্পীর গল্প নয়, বরং একজন মানুষের নিজের ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। পরবর্তী পর্বে আমরা এগিয়ে যাবো আলাপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের দিকে; যেখানে আরও গভীরভাবে উঠে এসেছে তার অভিজ্ঞতা ও ভাবনার প্রতিফলন।
আমাদের সঙ্গে থাকুন, দ্বিতীয় পর্বে চলবে কথোপকথনের পরবর্তী ধারা।
Usama Haque- (Facebook Page : https://www.facebook.com/share/16r4sy3G7S/)
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা
আনিকা শারমিলা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE