শুভ্র! এই নামটি শুনলেই একজন নির্ভেজাল, নিষ্পাপ মানুষের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদের তুলিতে আঁকা এই চরিত্রটি নিছকই একটি কাল্পনিক সত্তা নয়; তিনি যেন লেখকের ‘শুদ্ধতম মানুষ’ হওয়ার এক গভীর দার্শনিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। শুভ্র সিরিজের মূল উপন্যাস ‘শুভ্র‘ (প্রকাশিত ২০০০ সাল) চরিত্রটিকে আরও গভীরে নিয়ে যায়, উন্মোচন করে তার ভেতরের নিরাভরণ সৌন্দর্যকে।

হুমায়ূন আহমেদ শুভ্রকে নিয়ে মোট ৬টি উপন্যাস লিখেছেন। শুভ্র তার মধ্যে চতুর্থ বই। এটিতে আমরা শুভ্রকে আরও নিবিড়ভাবে চিনি। তার দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, চশমা ছাড়া প্রায় অন্ধত্ব, এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেন তার ভেতরের সরলতারই প্রতীক। সে এই জটিল দুনিয়ার মারপ্যাঁচ বোঝে না। অন্যের কপটতা, ছলনা তার বোধগম্যতার বাইরে। শুভ্র প্রায়শই এমন সব প্রশ্ন করে বা এমন কাজ করে বসে যা সাধারণের চোখে অদ্ভুত বা হাস্যকর মনে হতে পারে, অথচ তার গভীরে লুকিয়ে থাকে এক সহজ, নিরেট যুক্তি। তার এই নির্ভেজাল সারল্যই তাকে আলাদা করে তোলে।শুভ্রর প্রতিটি চিন্তাভাবনা, প্রতিটি কাজ যেন একটি শিশুর মতো সরল। তিনি জীবনে পাপ, মিথ্যা বা কপটতা কী, তা জানেন না। উপন্যাসে শুভ্রর এই সরলতা, তার অদ্ভুত যুক্তি এবং সহজ-সরল সমাধান প্রক্রিয়া পাঠককে মুগ্ধ করে।

উপন্যাসের এক জায়গায় যখন শুভ্রর মামা গুরুতর অসুস্থ এবং দুর্লভ ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত প্রয়োজন, তখন সবাই চিন্তিত। শুভ্র তখন নিস্পাপভাবে বলে, “তাহলে তো সব ‘ও নেগেটিভ’ মানুষের রক্ত চুষে নিতে হবে!” আপাতদৃষ্টিতে এই উক্তিটি হাস্যকর মনে হলেও, তার সরল মস্তিষ্কের কাছে এটিই ছিল সমস্যার সরাসরি সমাধান। সে বোঝাতে চেয়েছিল, যেহেতু রক্ত দরকার, তাই তা যেখান থেকে সম্ভব জোগাড় করতে হবে। এই ধরনের ঘটনাগুলোই শুভ্রকে একটি অনন্য চরিত্র করে তোলে, যা প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

আরেকটি দৃশ্যে, শুভ্র তার এক বন্ধুর সাথে কথোপকথনে সমাজের মিথ্যাচার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তার বন্ধু যখন মিথ্যা বলার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চেষ্টা করে, শুভ্র তখন পাল্টা প্রশ্ন করে, “মিথ্যা কেন বলতে হবে? সত্য বললে কি পৃথিবী থেমে যাবে?” এই সহজ প্রশ্নটি সমাজের গভীরে প্রোথিত মিথ্যাচারের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। শুভ্রর এই ধরনের প্রশ্নগুলো তার নিষ্পাপ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সত্যের প্রতি তার অটল বিশ্বাসকে ফুটিয়ে তোলে। সে সবকিছুকে তার নিজস্ব, নির্ভেজাল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, যা প্রায়শই প্রচলিত ধারণার বিপরীত হয়।

অনেক সময় শুভ্রকে একজন অ্যান্টি-হিরো হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সে প্রচলিত অর্থে কোনো শক্তিশালী বা পরাক্রমশালী চরিত্র নয়। বরং তার দুর্বলতা (দৃষ্টিহীনতা) এবং তার সরলতাই তাকে বিশেষ করে তুলেছে। এই সরলতার কারণেই সে সমাজের আরোপিত নিয়মকানুন বা কুটিলতার জালে জড়িয়ে পড়ে না। তার এই অ্যান্টি-হিরোসুলভ বৈশিষ্ট্যই তাকে পাঠকের কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য এবং ভালোবাসার পাত্র করে তোলে। সে সমাজের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলো দেখতে পায় না, কিন্তু তার সরলতা দিয়েই সেই অন্ধকারকে আলোকিত করে তোলে।

উপন্যাসটি শুভ্রর পারিবারিক সম্পর্ক, তার বন্ধুদের সাথে কথোপকথন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে তার মিথস্ক্রিয়াকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুভ্রর সংস্পর্শে এসে অনেক জটিল চরিত্রও যেন নিজেদের ভেতরের বিশুদ্ধতা খুঁজে পায়। হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শুভ্রর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, ভণ্ডামি এবং জটিলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তবে তা কোনো কড়া সমালোচনার সুরে নয়, বরং একটি নিষ্পাপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো হিউমার ও গভীর দর্শনের যুগপৎ উপস্থিতি, যা ‘শুভ্র’ উপন্যাসেও দেখা যায়। পাঠক হাসতে হাসতে জীবনের গভীর সত্যগুলো উপলব্ধি করতে পারেন। শুভ্রকে পড়ার সময় পাঠক যেন নিজের ভেতরের ‘শুদ্ধতম মানুষ’টিকে খুঁজে ফেরে। এটি শুধুমাত্র একটি চরিত্র নয়, একটি আয়না যেখানে আমরা নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পাই।এটি এমন একটি পাঠ যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলে এক ঝলক বিশুদ্ধ বাতাস এনে দেয়। যদি আপনি হুমায়ূন আহমেদের অনুরাগী হন এবং জীবনের সরলতা ও বিশুদ্ধতার এক অনন্য গল্প পড়তে চান, তবে ‘শুভ্র’ উপন্যাসটি আপনার জন্য অবশ্য পাঠ্য।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখক,

ঈষিতা তাবাসচ্ছুম মৌ

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE