মানুষের জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য একক কোনো সূত্র নেই, তবে মানসিকতার ধরন এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ক্যারল ডুয়েক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানুষের মানসিকতা মূলত দুটি প্রকারের হতে পারে: ফিক্সড মাইন্ডসেট (স্থির মানসিকতা) এবং গ্রোথ মাইন্ডসেট (বর্ধনশীল মানসিকতা)। যারা ফিক্সড মাইন্ডসেট ধারণ করেন, তারা মনে করেন যে তাদের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা জন্মগত এবং এগুলো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, গ্রোথ মাইন্ডসেটের অধিকারীরা বিশ্বাস করেন যে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও শেখার মাধ্যমে যে কোনো দক্ষতা উন্নত করা সম্ভব। সফলতার জন্য গ্রোথ মাইন্ডসেট গড়ে তোলার কৌশলগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা
সফল ব্যক্তিরা সবসময় চ্যালেঞ্জকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন। ব্যর্থতাকে তারা শেষ নয়, বরং শেখার একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। জীবন চলার পথে বাধা আসবে, কিন্তু একজন গ্রোথ মাইন্ডসেটের অধিকারী ব্যক্তি সেটাকে নিজের উন্নতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ছাত্র-ছাত্রীরা যখন বিশ্বাস করে যে তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব, তখন তারা নতুন কিছু শেখার জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফলাফল করে। সুতরাং, প্রতিদিন ইতিবাচক চিন্তা করা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা গ্রোথ মাইন্ডসেট গড়ে তোলার অন্যতম কৌশল।
২. চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা
যারা গ্রোথ মাইন্ডসেট ধারণ করেন, তারা চ্যালেঞ্জকে ভয় পান না; বরং সেটাকে শেখার নতুন সুযোগ হিসেবে নেন। সফল উদ্যোক্তারা, বিজ্ঞানীরা কিংবা ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা সবসময় কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং ব্যর্থ হলেও চেষ্টা চালিয়ে যান।
উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত উদ্ভাবক থমাস এডিসন হাজারো ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তার মতে, “আমি ব্যর্থ হইনি, আমি শুধু এমন ১০,০০০ উপায় খুঁজে পেয়েছি যেগুলো কাজ করে না।”
তাই, আমাদেরও উচিত যেকোনো চ্যালেঞ্জকে ভয় না পেয়ে সেটাকে সৃজনশীলভাবে সমাধান করার চেষ্টা করা।
৩. ভুল থেকে শেখা ও গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করা
একটি সাধারণ প্রবণতা হলো মানুষ ব্যর্থতা বা সমালোচনাকে নেতিবাচকভাবে নেয়। কিন্তু যারা গ্রোথ মাইন্ডসেট অনুসরণ করেন, তারা ভুল থেকে শিক্ষা নেন এবং গঠনমূলক সমালোচনাকে উন্নতির জন্য ব্যবহার করেন।
সফল ব্যক্তিরা জানেন যে, সঠিক পর্যালোচনা ছাড়া উন্নতি করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, স্টিভ জবস তার কর্মীদের কঠোর পর্যালোচনা করতেন এবং নিজের কাজের ক্ষেত্রেও সমালোচনাকে গুরুত্ব দিতেন। ফলে তিনি নতুন উদ্ভাবনের পথ খুঁজে পেতেন।
আমাদেরও উচিত ভুলগুলোকে শেখার মাধ্যম হিসেবে দেখা এবং অন্যদের গঠনমূলক সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা।
৪. অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রম করা
শুধুমাত্র প্রতিভা দিয়েই কেউ বড় কিছু অর্জন করতে পারে না; এজন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। সফল মানুষরা জানেন যে প্রতিদিন সামান্য উন্নতি করাও ভবিষ্যতে বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে:
“Success is not the result of spontaneous combustion. You must set yourself on fire.“
অর্থাৎ, সফলতা হুট করে আসে না, বরং নিজেকেই আগ্রহের আগুনে জ্বালিয়ে নিতে হয়।
তাই, আমাদের উচিত নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে প্রতিদিন একটু একটু করে কাজ করা, যাতে দীর্ঘমেয়াদে বড় সফলতা অর্জন হয়।
৫. শেখার প্রতি আগ্রহ বজায় রাখা
গ্রোথ মাইন্ডসেট তৈরির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নতুন কিছু শেখার প্রতি আগ্রহ বজায় রাখা। সফল ব্যক্তিরা সবসময় শেখার জন্য উন্মুখ থাকেন। তারা বই পড়েন, নতুন দক্ষতা অর্জন করেন এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট রাখেন।
বিল গেটসের কথাই ধরা যাক। তিনি প্রতি বছর শতাধিক বই পড়েন এবং নতুন জ্ঞান অর্জন করেন, যা তাকে আরও সফল হতে সাহায্য করে।
তাই, আমাদেরও উচিত প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার অভ্যাস গড়ে তোলা।
৬. ‘আমি পারবো না’ ধারণা পরিহার করা
অনেকে মনে করেন, “আমি তো এটা পারবো না” বা “এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।” কিন্তু সফল ব্যক্তিরা জানেন যে চেষ্টা করলে সবকিছুই সম্ভব।
ক্যারল ডুয়েকের গবেষণা অনুযায়ী, যখন শিক্ষার্থীরা মনে করে যে তারা উন্নতি করতে পারে, তখন তাদের শেখার হার বৃদ্ধি পায়। এজন্য, আমরা যদি কোনো কিছুতে দুর্বল হই, তবে সেটাকে উন্নত করার জন্য চেষ্টা করা উচিত, না যে সেটা কখনো সম্ভব নয়।
৭. অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষদের সঙ্গ গ্রহণ করা
আমাদের আশেপাশের পরিবেশ ও মানুষ আমাদের মানসিকতায় বড় ভূমিকা রাখে। যদি আমরা সবসময় নেতিবাচক মানুষদের সাথে থাকি, তাহলে তারাও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমাবদ্ধ করে দেবে। কিন্তু যদি আমরা ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষদের সঙ্গ গ্রহণ করি, তাহলে তারাও আমাদের উৎসাহিত করবে।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “Try not to become a man of success, but rather try to become a man of value.”
অর্থাৎ, কেবল সফল হওয়ার চেষ্টা না করে বরং মূল্যবান ব্যক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করা।
৮. ধৈর্য ও মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
সফলতার জন্য ধৈর্য অপরিহার্য। অনেক সময় আমরা কোনো কাজ শুরু করার পর কিছুদিনের মধ্যে তা ছেড়ে দিই, কারণ ফলাফল আসতে সময় লাগে। কিন্তু গ্রোথ মাইন্ডসেটের অধিকারীরা জানেন যে সাফল্য একদিনে আসে না, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।
ধৈর্য ধরে কাজ করা, হতাশ না হয়ে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করা, এবং লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া—এগুলিই সফলতার আসল চাবিকাঠি। সফলতার জন্য কেবল প্রতিভা নয়, বরং মানসিকতার ধরন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রোথ মাইন্ডসেট গড়ে তুললে আমরা প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে পারি এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে বড় অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
এই মানসিকতা অর্জনের জন্য আমাদের ইতিবাচক চিন্তা করা, কঠোর পরিশ্রম করা, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ বজায় রাখা এবং ধৈর্য ধরে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। সাফল্য কোনো গন্তব্য নয়, বরং এটি একটি যাত্রা। আর এই যাত্রায় গ্রোথ মাইন্ডসেট আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সঙ্গী হতে পারে।
এই ধরণের আরও ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
অভীক দে সাম্য
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং বিভাগ
YSSE।