ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। জামালপুরের ভাষা তার নিজস্ব মায়াবী টান ও স্বতন্ত্র উচ্চারণের জন্য অনন্য। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, স্থানীয় ভাষার প্রতিটি শব্দ কেমন করে যুগের পর যুগ মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে? আসুন, ঘুরে আসি জামালপুরের মাটির ঘ্রাণ মেশানো ভাষার জগতে।

জামালপুরের মানুষ তাদের কথোপকথনে শব্দ সংক্ষেপ, স্বরের পরিবর্তন এবং স্থানীয় কিছু শব্দের ব্যবহার করে যা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে একেবারে নতুন মনে হতে পারে। এই ভাষার সুর ছন্দ একেবারে সহজ, মোলায়েম এবং মধুর। কথার মধ্যে আন্তরিকতা এবং আপনভাব ফুটে ওঠে, যা এই ভাষাকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। 

ভাষার পেছনে ইতিহাস ও সংস্কৃতি

জামালপুরের ভাষার গঠন প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের ভাষার বিবর্তনের ফসল। ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ের এই অঞ্চল কৃষিনির্ভর এবং এখানকার মানুষের জীবনধারা অত্যন্ত সরল। তাই এখানকার ভাষাও সহজ-সরল, কিন্তু একইসঙ্গে প্রাণবন্ত। জামালপুরের ভাষা মূলত মুখের ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। সাহিত্যিক বা আনুষ্ঠানিক লেখালেখিতে এটি তেমন দেখা যায় না, তবে স্থানীয় গ্রামীণ গান, পালাগান, যাত্রাপালা, ও মেলা উপলক্ষে প্রচলিত লোকসংগীতে এই ভাষার সৌন্দর্য প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। বিশেষ করে, জামালপুরের নকশিকাঁথার সঙ্গে এই ভাষার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। গ্রাম্য নারীরা যখন সুঁই-সুতো হাতে নিয়ে নকশিকাঁথা বোনেন, তখন তাঁদের মুখে মুখে গড়ে ওঠে মিষ্টি জামালপুরী ভাষায় ভরা গল্প। সেই গল্পে থাকে দুঃখ, সুখ, ভালোবাসা ও অতীতের স্মৃতি। 

ভাষার টিকে থাকার সংগ্রাম

প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে অনেক তরুণ এখন শুদ্ধ বাংলা বা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফলে জামালপুরের আদি ভাষা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে পরিবারের বড়রা, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ, এখনো এই ভাষা ধরে রেখেছেন। তবে আশার কথা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জামালপুরী ভাষার প্রচার বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ভিডিও, নাটক কিংবা গান, এসবের মাধ্যমে এই ভাষার জনপ্রিয়তা আবারও বাড়ছে। অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করছেন, যা নতুন প্রজন্মের কাছে এই ভাষাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।

জামালপুরের ভাষার সৌন্দর্য

জামালপুরের ভাষা শুধু কথোপকথনের মাধ্যম নয়, এটি আবেগ প্রকাশের এক অনন্য উপায়। দাদির গল্পে থাকে ভাষার মায়া, কৃষকের মুখে থাকে শ্রমের গল্প, বাউল গানের সুরে মিশে থাকে হৃদয়ের ব্যথা। এই ভাষার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উচ্চারণ যেন এক টুকরো শিল্প। যখন কেউ এই ভাষায় কথা বলে, তখন মনে হয় এটি শুধু ভাষা নয়, বরং মনের গভীর অনুভূতি প্রকাশের এক মাধ্যম। 

ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে শুধুমাত্র কিছু শব্দ হারানো নয়, বরং একটি সংস্কৃতি ও পরিচয় মুছে যাওয়া। জামালপুরের স্থানীয় ভাষা সংরক্ষণ করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের শেকড় ধরে রাখা। আঞ্চলিক ভাষার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একটি সমাজের আসল রূপ। এজন্য স্কুল-কলেজে আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব শেখানো, স্থানীয় ভাষায় গল্প-গান সংরক্ষণ করা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে এর প্রচার বাড়ানো দরকার।

জামালপুরের ভাষা এক টুকরো অনুভূতি, যেখানে মিশে আছে স্নেহ, হাসি, গল্প আর জীবনের স্বাদ। গ্রামের মাঠে কৃষকের কথা, খালের ধারে জেলেদের ডাক, কিংবা নকশিকাঁথার সুঁই-সুতোর মধ্যে যেমন ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, তেমনি জামালপুরের ভাষাতেও মিশে আছে চিরচেনা এক মায়ার বন্ধন। ভাষার মিষ্টতা টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। 

আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন। 

লেখিকা

সুমাইয়া নুসরাত 

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE