উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু ব্যবসা করা নয়, বরং নতুন কিছু তৈরি করা, কঠোর পরিশ্রম করা, এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া।আফসারা তাসনিম মিশু সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন “রঙিন পিঁপড়া”-এর মাধ্যমে। শৈশব থেকে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, মায়ের অনুপ্রেরণা, আর নিজের সৃজনশীল চিন্তাধারাকে কাজে লাগিয়ে তিনি শুরু করেন কাঠ খোদাই ব্লকপ্রিন্টের ব্যবসা।
মাত্র তিন হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করা এই উদ্যোগ আজ অনেকের কাছে পরিচিত। তবে এই পথচলা সহজ ছিল না—ধৈর্য, পরিশ্রম, আর নতুন কিছু করার ইচ্ছাই তাকে এগিয়ে নিয়েছে। তার লক্ষ্য শুধু ব্যবসার প্রসার নয়, বরং নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি করাও।
এই সাক্ষাৎকারে তিনি শেয়ার করেছেন তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। যারা নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করতে চান, তাদের জন্য এটি হতে পারে এক দারুণ অনুপ্রেরণা!
YSSE: আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন। (নাম, পড়াশোনা, বর্তমানে কী করছেন, আপনার বেড়ে ওঠা ইত্যাদি)
Afsara Tasnim Mishu: আমি আফসারা তাসনিম মিশু। আমার জন্ম চাঁদপুরে, তবে আমার বেড়ে উঠা রাজশাহী শহরে। আমার পরিবার বর্তমানে রাজশাহীতে অবস্থান করছে, বর্তমানে আমি হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছি।
YSSE: আপনার “রঙিন পিঁপড়া” পেজ সম্পর্কে কিছু বলুন। যেমন- রঙিন পিঁপড়া নাম দেয়ার কারণ কী? কী বিষয় নিয়ে কাজ করেন?
Afsara Tasnim Mishu: প্রথমদিকে আমি ব্লক,বাটিক,হ্যান্ডপেইন্টের রং কেমিকাল সেল করতাম। বছরখানেক রং কেমিকেল নিয়ে কাজ করার পর আমার মনে হয় এই সেক্টরে রং কেমিকেল অনেকেই সেল করে,যাদের মধ্যে কোনো সৃজনশীলতা-নতুনত্ব নেই। আমার একটা অনন্য পরিচয় দরকার, যা দিয়ে মানুষ আমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারবে,সবার মাঝে আলাদাভাবে চিনবে,আমার নতুনত্ব এবং সৃজনশীলতাকে খুঁজে নেবে।
তাই আমি কাঠ খোদাই করে ব্লকপ্রিন্টের ডাইস তৈরির দিকে আগ্রহী হই,যেখানে নতুনত্ব এবং সৃজনশীলতা থাকবে। এবার আমি নামের প্রসঙ্গে আসি। শুরুর দিকে আমি নিজ পেজের নাম দিয়ে কাজ না করে আমার পরিচিত এক দোকানের নাম দিয়ে কাজ করতাম। পরবর্তীতে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে নিজের মত একটা নাম দিয়ে নতুন পেজ খুলবো। পেজ এর জন্য নাম খুঁজছি, এমন একদিন, আমি ফ্লোরে বসে হ্যান্ডপেইন্ট করছিলাম, নজরে আসে একটা পিঁপড়া রং এর উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে। সেখান থেকে আমার মাথায় রঙিন পিঁপড়া নামটা আসে,আমি আমার ফেইসবুক পেজ এর নাম রাখি এই নামে।
YSSE: আপনি “রঙিন পিঁপড়া” শুরু করেছিলেন কবে? আপনার এই উদ্যোগে আসার মূল কারণ কী ছিল? কীভাবে এই উদ্যোগটি দাঁড় করালেন বা পেছনের গল্পটা যদি বলেন?
Afsara Tasnim Mishu: অনেক আগ থেকে আমার ইচ্ছা ছিল পেইন্টিং রিলেটেড আইটেম গুলো নিয়ে কাজ করার। আমার আগ্রহ তৈরি হয় আমার আম্মুর কাজ দেখে। আমি ছোট থেকে দেখে এসেছি আমার মা ব্লকপ্রিন্ট, হ্যান্ডপেইন্ট ইত্যাদি কাজ করে। সেখান থেকেই মূলত আমার এই কাজে যুক্ত হওয়া, এর পাশাপাশি আমার ক্রাফটিং নিয়ে আগ্রহ ছিল অনেক।
মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া পর থেকে পরিকল্পনা ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সেসময়ে আমি আমার এই শখের কাজ গুলোকে আয়ের উৎসে পরিণত করবো বলে সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৭ সালে একটি ফেসবুক পেজ খুলি,যদিও তখন আমি সফল হতে পারিনি।
আর তারপর উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা-অ্যাডমিশন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় উদ্যোগের সাথে লেগে থাকা হয়নি। ২০২০ সাল,বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দুই মাস পর শুরু হয় করোনা মহামারী। করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটিতে সারাদিন বাসায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করে দিন কাটতো। এদিকে আমার আগে থেকেই চিন্তা ভাবনা ছিল ফিনান্সিয়ালি আত্মনির্ভরশীল হওয়ার,তাই আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতাম, কিন্তু তখনও মন স্থির করতে পারিনি ঠিক কি নিয়ে কাজ করবো।করোনাকালীন সেসময়ে অনেকে বিভিন্ন ক্রাফটিং গ্রুপে তাদের নিজস্ব কাজ এবং প্রতিভার প্রকাশ-প্রচার করতো। এমনই একদিন কোনো এক গ্রুপের হেল্প পোস্টে একজন পেইন্টিং রিলেটেড কিছু কেমিক্যালের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। মায়ের কাজ গুলো কাছ থেকে দেখার সুবাদে সেই কেমিক্যাল সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল। তাই আমি পোস্টদাতা আপুকে যখন এই তথ্য দিয়ে হেল্প করি তখন আমার মাথায় আসে যে, আমি তো এইটা নিয়েও কাজ করতে পারি। এই সময়কালটা ছিল ২০২০ এর জুলাই মাস, তখন আমি বাজারের দোকানে গিয়ে কিছু ছবি তুলে আমার ২০১৭ সালের তৈরি করা সেই ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়েছিলাম। আমি সত্যিই ভাবিনি যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবো মানুষের মাঝে শুরুতেই। প্রথম মাসে খুব ভালো একটা সেল হয় যা আমার কাছে পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল।
গ্রাহকরাও আমার পণ্য নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম আমি, শুরু থেকেই প্রতি মাসের সেলে যেটুকু প্রফিট থাকে তা থেকে নিজেদের প্রযোজন মিটিয়ে বাকিটা আমি আবার ইনভেস্ট করি। এই নীতি আমি এখন পর্যন্ত মেনে চলি।
YSSE: ‘রঙিন পিঁপড়া’ ছাড়াও আপনি কি অন্য কোনো উদ্যোগের সাথে যুক্ত আছেন?
Afsara Tasnim Mishu: না। আমি অন্য কোনো উদ্যোগের সাথে জড়িত নই। আমি বর্তমানে আমার এই কাজেই মনোনিবেশ রাখতে চাই।
YSSE: কোন কোন দক্ষতা অর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাজটিতে?
Afsara Tasnim Mishu: এই কাজে প্রফেশনালি গ্রাহকদের সাথে কথা বলা এবং কাজ করাটা অনেক অরুরি। অনেক সময় গ্রাহকদের থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়, সেগুলো আপনাকে ঠান্ডা মাথায় সমাধান করতে হবে,ধৈর্যশীল হতে হবে। আপনাকে টাইম ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নিজের কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এইখানে।
YSSE: আপনার অনুপ্রেরণা কারা বা কী ছিল?
Afsara Tasnim Mishu: করোনার শুরুর দিকে আমার পেজ থেকে ভালো সেল হতো। কাজের চাপের কারণে প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সে সময়ে আমার সবথেকে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার মা। আম্মু আমাকে অনুপ্রেরণা না দিলে আমি এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না। আমার বাবাও আমার আরেক বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন। আমি কিভাবে বিজনেসটা শুরু করবো,কিভাবে ডিল করবো সবকিছুতে উনার অনেক সাপোর্ট ছিল।
YSSE:আপনার এই সফলতার পেছনে প্রতিবন্ধকতা ছিল কি? থাকলে সেগুলো কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং কীভাবে সেগুলো সমাধান করেছিলেন?
Afsara Tasnim Mishu: শুরুতেই আমি বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা ফেস করি। করোনার সময় দোকান অনেকদিন বন্ধ থাকায় আমার প্রথম দুই কাস্টমারের অর্ডারকৃত রং নষ্ট ছিল। এইটা ছিল আমার জন্য বড় একটি ধাক্কা। কিন্তু আমি তখন হাল ছাড়িনি। আবার নতুন করে রং-কেমিক্যাল সংগ্রহ করে তাদের কাছে পৌঁছে দেই। আমি এভাবে এই সমস্যাটা কাটিয়ে উঠি।
আরেকটা প্রতিবন্ধকতা ছিল সময়। শুরুর দিকে আমাকে প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ ঘন্টা কাজ করতে হতো। ফেইসবুক পেজের পোস্ট দেয়া থেকে শুরু করে, কমেন্টের উত্তর দেয়া, ইনবক্সে জবাব দেওয়া সব আমাকেই করতে হতো। এর পাশাপাশি অর্ডার কনফার্ম, পেমেন্ট চেক, অর্ডার লিস্ট ডাউন, প্রডাক্ট কুরিয়ার করা সব একাই করতাম আমি। যার কারণে আমাকে সময় নিয়ে হিমশিম খেতে হতো প্রতিনিয়ত। তার পাশাপাশি আমার পড়াশোনার চাপ এবং শারীরিক অসুস্থতাও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
YSSE: বর্তমানে কতজন কাজ করছে আপনার এই উদ্যোগে?
Afsara Tasnim Mishu: আমার পেজে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনলাইনে দুইজন মডারেটর এবং কিছু সেলস এক্সেকিউটিভ কাজ করছেন। তাছাড়াও আমার দুইজন কারিগর রয়েছেন। তারা আমার সাথে কাজ করে কিছুটা হলেও স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন।
YSSE: কেন ‘রঙিন পিঁপড়া’ অন্য সকল উদ্যোগ থেকে আলাদা বলে আপনার মনে হয়?
Afsara Tasnim Mishu: আমার পেজের প্রধান পণ্য হচ্ছে কাঠের তৈরি ডাইস। যেগুলো খুব সহজেই ঢাকার নিউ মার্কেটে পাওয়া যায়,অনলাইনেও পাওয়া যায়। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে তাদের ডিজাইন গুলো সচরাচর একই ধাচের। যেখানে কি না আমার ডিজাইন গুলো তাদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। আমি বিভিন্ন থিম যেমন পূজা, বৈশাখ, ফাল্গুন, ঈদ, নব্বই দশক, সমুদ্র, আদিবাসী ইত্যাদি নিয়ে কাজ করি। এই বিশেষত্বের কারণে আমি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি। আর তাই আমি মনে করি ‘রঙিন পিঁপড়া’ অন্য সব উদ্যোগ থেকে আলাদা।
YSSE: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
Afsara Tasnim Mishu: আমি কাজের বিশেষত্বে বিশ্বাসী। আমার নিজস্ব কারিগর রয়েছেন যারা আমাকে পছন্দমতো ডিজাইনে কাজ করতে সাহায্য করেন। সুযোগ পেলে আমার ফ্যাক্টরি দেয়ার ইচ্ছা আছে,যেখানে নিজস্ব ডিজাইনে কাঠের ডাইস তৈরি থেকে শুরু করে নিজস্ব ডিজাইনের পোষাক তৈরি করা হবে।এই পরিকল্পনার আরেকটি কারণ মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা। ট্রেনিং এর মাধ্যমে খুব সহজে তারা ব্লকপ্রিন্টের কাজ করতে পারবেন এবং আয় করতে পারবেন। বর্তমানে আমার একাডেমিক চাপের কারণে সেভাবে সময় দেয়া সম্ভব নয়, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমি সফল হবো আমার এই পরিকল্পনায়।
YSSE:একজন উদ্যোক্তা হিসেবে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
Afsara Tasnim Mishu: আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলবো আত্মনির্ভরশীল হতে এবং তা সাধারণ কোনো মাধ্যমে না,বরং অসাধারণ কোনো কাজের মাধ্যমে। আমাদের আশেপাশে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম কাজ করেন, তাদের চাইতে কিভাবে আমি আলাদা হবো, কেন মানুষ বাকি দশজনের মাঝে আমাকে বেছে নিবে এই বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে সব সময়। এক কথায় উদ্যোক্তা হিসেবে আমার পরামর্শ থাকবে কাজের মাধ্যমে নিজের বিশেষত্ব অর্জন করা।
আপনাদের সমর্থন এবং ভালোবাসাই একজন উদ্যোক্তার এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। সবাই সুস্থ থাকুন, স্বপ্ন দেখুন এবং সাহস নিয়ে নিজের পথ গড়ে তুলুন—ধন্যবাদ ।
To read more blogs like this, Click here
Writer
Samsul Alam Roni
Intern, Content Writing Department
YSSE