সৌরজগত হলো সূর্য এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণকারী তথা পরস্পরের প্রতি অভিকর্ষ টানে আবদ্ধ মহাজগতিক বস্তুগুলোকে নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ব্যবস্থা।যার সৃষ্টি একদিনে হয়নি লেগেছে বছরের পর বছর।যার দূরত্ব আকাশমণ্ডল থেকে প্রায় ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে। একে প্রদক্ষিণ করে আটটি বিরাট গ্রহ অবস্থান করছে, পাশাপাশি প্রদক্ষিণ করছে সৌরজগতের ক্ষুদ্রতম গ্রহ সমূহ।পৃথিবী ও সূর্য তথা সৌরজগতের জন্ম নিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নানা ধরনের পৌরাণিক উপকথা প্রচলিত আছে। সেগুলো শুনতে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবতার সাথে মিল বহুদূর। বাস্তবতা জানতে হলে অনুসন্ধান করতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ।
সৌরজগতের উৎপত্তি নিয়ে এখন পর্যন্ত যে মতবাদ প্রচলিত আছে তা অনেকটা এরকম- সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ জন্মের আগে বিস্তৃত এলাকা ব্যাপী গ্যাসীয় মেঘ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। একদম শুরুতে কয়েক আলোক বর্ষ ব্যাপী এলাকা নিয়ে মহাজাগতিক গ্যাস ও ধূলি বিদ্যমান ছিল। কয়েক আলোক বর্ষ এই এলাকাটা কতটুকু বিশাল? শুনতে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু এর বিশালতা ব্যাপক। আলো এক সেকেন্ডে অতিক্রম করে ৩ লক্ষ কিলোমিটার। ১ মিনিটে যায় এর ৬০ গুণ। এক ঘণ্টায়? আরো ৬০ গুণ। এক দিনে? এক মাসে এক বছরে? এভাবে গুণ দিয়ে আসলে দেখা যাবে কল্পনাতীত পরিমাণ বড় এক এলাকা নিয়ে ছিল সৌরজগতের প্রাথমিক গাঠনিক উপাদানগুলো।
এরপর হলো মেঘপুঞ্জ এর আকর্ষণ যার কারণে গ্যাসের মেঘগুলো পরস্পরের কাছে আসতে শুরু করলো। কী ঘটতে পারে সেটা? যা হতে পারে পাশ দিয়ে ভারী কোনো নক্ষত্র অতিক্রম করে গিয়েছে যার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বস্তুগুলো এক দিকে এসে একত্রিত হওয়া শুরু করেছিল। অথবা এমনও হতে পারে কোনো শক ওয়েভের ধাক্কায় বস্তুগুলো একদিকে সংকুচিত হওয়া শুরু করেছিল। শক ওয়েভ যেদিক দিয়ে যায় সেদিকের বস্তুগুলোকেও নাড়িয়ে যায় কিংবা সাথে নিয়ে যায়। ভূমিকম্পের সময় মাটিতে আন্দোলন হয় শক ওয়েভের কারণেই। সেখানে কীভাবে শক ওয়েভ তৈরি হতে পারে? সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে কিংবা বড় কোনো মহাজাগতিক ঘটনায় শক ওয়েভ তৈরি হতে পারে।
তো একত্রীকরণের পেছনে যে কারণই থাকুক, যেভাবেই হোক বস্তুগুলো একত্রিত হওয়া শুরু করেছিল। এরপর আর কিছু করতে হয়নি। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে নিজেই গঠন করে ফেলেছে সৌরজগৎ। একবার পথ দেখানোর পর পথিক নিজেই নিজের আলোতে বাকি পথ চিনে নিয়েছে।
যখন বস্তুগুলো একটুখানি কাছে আসা শুরু করেছে তখন একটির সাথে আরেকটি মিলে বড় বস্তু তৈরি করেছে। এখানে কাজ করেছে মহাকর্ষ বল।বস্তুর ভর কম হলেও মহাশূন্যে কম ভরের আকর্ষণেরও ভালো প্রভাব থাকে। এখন বস্তুটি একটু বড় বা ভারী হওয়া মানে এর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ আরো বেশি হবে। ফলে আশেপাশের আরো বস্তুকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারবে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলছে বস্তুর ভর যত বেশি হবে আকর্ষণের পরিমাণ তত বেশি হবে। ফলে একসময় ভারী হতে হতে বিস্তৃত এলাকা ব্যাপী মহাকর্ষীয় প্রভাব বিস্তার করবে।
সৌরজগতের ক্ষেত্রে যে অংশে সবচেয়ে বেশি বস্তু জমা হয়েছিল সেটি বর্তমানে সূর্য। সূর্যের মধ্যে এত বেশি বস্তু জমা হয়েছিল যে প্রবল মহাকর্ষের চাপে ভেতরের বস্তুগুলো আর স্বাভাবিক থাকতে পারেনি। সংঘটিত হওয়া বস্তুগুলোর মাঝে বেশিরভাগই হাইড্রোজেন গ্যাস। প্রবল চাপে পড়ে তারা উত্তপ্ত হয়ে উঠে। গ্যাসের সূত্র অনুসারে চাপ বাড়লে তাপমাত্রা বাড়ে। এখানে সেটিই হয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে এতই উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে এক পরমাণু আরেক পরমাণুর ভেতর ঢুকে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল।ফিউশন বিক্রিয়ায় তাপ ও আলোকশক্তি অভিমুক্ত হয়। যার ফলে সূর্যটি জ্বলে উঠে। সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত সূর্য আলো ছড়াচ্ছে যা নেভেনি এখনো। ভেতরে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাবে এমন জ্বালানি শেষ হবার আগ পর্যন্ত জ্বলতেই থাকবে।
সূর্য ছাড়া অন্য কোনো গ্রহেরও সুযোগ ছিল জ্বলে উঠার। যেমন বৃহস্পতি, এর ভর তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। কিন্তু জ্বলে উঠতে হলে ন্যূনতম যে ভর অর্জন করতে হয় তা অর্জন করতে পারেনি সে। তাই আর জ্বলে উঠতে পারেনি। যদি বৃহস্পতি গ্রহও জ্বলে উঠতো তাহলে সৌরজগতে সূর্য থাকতো দুটি। আর একে বলা হতো বাইনারি স্টেলার সিস্টেম। মহাবিশ্বে এরকম যুগল নক্ষত্রের অনেক উদাহরণ আছে। স্টার ওয়ার্স চলচ্চিত্রগুলোতে এরকম যুগল নক্ষত্র দেখা যায় প্রায়ই।
সূর্য যখন চারপাশ থেকে বস্তু ধারণ করছিল তখন তার পাশাপাশি অন্যান্য স্থানেও টুকটাক ছোট ছোট বস্তুর সংগ্রহ হতে থাকে। যে যার মতো করে পেরেছে নিজের দিকে আকর্ষণ করেছে। এদের মধ্যে যারা বেশি ভারী হয়ে গিয়েছিল তারা গ্রহ কিংবা উপগ্রহ হিসেবে বিদ্যমান আছে। আর যারা খুব বেশি ভারী হতে পারেনি তারা শেষমেশ সূর্যে গিয়ে ঠেকেছে কিংবা পার্শ্ববর্তী গ্রহে গিয়ে মিশেছে। উদাহরণ, পৃথিবীতে প্রায় সময় ঘটে যাওয়া উল্কাপাত।
সূর্য তো গ্রহগুলোকে আকর্ষণ করছে, তাহলে গ্রহগুলো কেন সূর্যের বুকে পড়ে যায় না কিংবা উপগ্রহগুলো কেন গ্রহে গিয়ে ঠেকে না? আসলে গ্রহদের দিক থেকে গ্রহগুলো ঠিকই সূর্যের উপর পড়ছে কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের একটা নিয়মের প্রভাবে সেই পড়া আর সূর্যের গা পর্যন্ত যায় না। খুব সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়, সৌরজগৎ গঠনের সময় গ্রহগুলোতে একটি বহির্মুখী বল তৈরি হয়, আবার অন্যদিকে সূর্যের আকর্ষণের ফলে একটি কেন্দ্রমুখী বলও বিদ্যমান। দুই বলের টানাটানিতে গ্রহগুলো না যেতে পারে বাইরের দিকে না আসতে পারে ভেতরের দিকে।
দুই বল (ভেক্টর রাশি) যদি দুই দিকে টানাটানি করে তাহলে বস্তুটি দুই দিকের কোনো দিকে না গিয়ে ৩য় একটি দিকে যাবে (লব্ধি ভেক্টর)। এটা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম। গ্রহগুলোর ঘূর্ণনের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়। দুই বলের টানাটানিতে লব্ধি হিসেবে ঘুরতে থাকে।
পৃথিবী গঠনের পর এতে কোনো পানি ছিল না।খুব বেশি উত্তপ্ত ছিল পুরো গ্রহ। গ্রহাণু ধূমকেতুরা এসে আছড়ে পড়তে লাগলো পৃথিবীর পৃষ্ঠে। ধূমকেতুতে প্রচুর পানি ও বরফ থাকে। এই পানি ও বরফের প্রভাবে শীতল হয়ে এলো পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠ। শুধু শীতলই হয়নি, সাগর মহাসাগরের পানিগুলোর উৎসও এরাই। অন্তত সাম্প্রতিক গবেষণা তা-ই বলে। পানি থাকাতে এর মাঝে প্রাণ ধারণ করার পরিবেশ অনুকূল হয়। সেখানে জন্ম নেয় এক কোষী প্রাণ। তারপর ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবী ছেয়ে যায় প্রাণিবৈচিত্র্যে। সেখানে বাস করছি আমরা মানুষেরা ও অন্যান্য প্রাণি সমূহ।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখিকা
মোর্শেদা বেগম।
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE