প্রযুক্তি, সমস্যাবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার এক অসাধারণ সমন্বয় – এই তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে “Your Campus”। তারই প্রতিষ্ঠাতা মো: মিলজার রহমান, যাঁর গল্প শুরু হয়েছে মফস্বলের ছোট্ট শহর থেকে, পেরিয়েছে বুয়েটের টানাপোড়েনময় ছাত্রজীবন এবং বর্তমানে পরিবর্তন করছে দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন।
শৈশব থেকে বুয়েট পর্যন্ত – একটি অস্থির কিন্তু শিক্ষণীয় যাত্রা
১৯৮৬ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন মো: মিলজার রহমান। শৈশবকাল কেটেছে রঙিন কিন্তু অস্থিরতার মধ্যে। ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত একাধিক স্কুল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও ক্লাস সিক্স থেকে পড়াশোনা করেছেন নড়াইল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২০০৪ সালে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর স্বপ্ন পূরণের পথে তিনি পা রাখেন বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়ে।
বুয়েট জীবনে তাঁর মনোযোগ শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে অংশগ্রহণ করে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের বহুমাত্রিক দিকগুলো আবিষ্কার করেন। একাডেমিক পারফরম্যান্সে খানিকটা পিছিয়ে পড়লেও তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবনের আসল শেখাগুলো শুধু ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
“Your Campus” এর জন্ম
হলে থাকাকালীন অবস্থায় মিলজার খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন সাধারণ কিছু সমস্যার গভীরতা – কাপড় ধোয়ার ঝামেলা, নোংরা বিছানার চাদর কিংবা মাঝরাতে হোস্টেলে কিছু খেতে না পাওয়ার মতো ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ অভাব।
একদিন তাঁর মনে হয়েছিল – যদি এমন সাধারণ একটা সমস্যারও টেকসই কোনো সমাধান না থাকে, তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? এখান থেকেই শুরু হয় টেকনোলজির মাধ্যমে এই দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান দেওয়ার ভাবনা এবং গড়ে ওঠে “Your Campus”। যার শুরুটা ছিল কাপড় ধোয়ার জন্য IoT নির্ভর একটি স্মার্ট ওয়াশিং সিস্টেম এবং শিক্ষার্থীদের জরুরি পণ্য কেনার জন্য ক্যাম্পাসভিত্তিক ভেন্ডিং মেশিনের ধারণা।
প্রযুক্তি নির্ভর সেবার পথ বেছে নেওয়ার পেছনে কারণ
IoT নির্ভর সেবা বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে তাঁর নিজস্ব জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে। ম্যানুয়ালি কাপড় ধোয়ার পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ, ব্যয়সাধ্য এবং তা শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রুটিনের সাথে মানানসই নয়। সেই জায়গা থেকেই আসে অটোমেটেড, স্মার্ট ও নির্ভরযোগ্য সিস্টেম তৈরির ভাবনা।
ভেন্ডিং মেশিনের ক্ষেত্রেও একই দর্শন – শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস যেন হাতে পাওয়ার মতো সহজ হয়। যদিও এগুলো থেকে এখনও বড় লাভ আসেনি। কিন্তু তিনি বরাবরই বিশ্বাস করেছেন, ব্যবসা শুধু লাভ নয় বরং প্রভাব তৈরি করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
“Your Offers” – একটি চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ
“Your Campus” এর বিভিন্ন সেবার মধ্যে “Your Offers” ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। এই ই-কমার্স ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছে দিতে কাজ করে। তবে অনেক শিক্ষার্থী প্রথমদিকে এটি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দিহান থাকায় সেবার গ্রহণযোগ্যতা পেতে সময় লেগেছে।
পাশাপাশি ওয়াশিং মেশিন বা ভেন্ডিং মেশিন এর ব্যবহারিক কার্যকারিতার দরুণ সেগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়। কিন্তু “Your Offers”-এর ক্ষেত্রে মার্কেটিং, ডেলিভারি লজিস্টিকস এবং ব্যবহারকারীদের সচেতনতা তৈরির বিষয়গুলো একসাথে সামলাতে হয়েছে।
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাস্তব বাধাসমূহ
একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি শুরুতেই উপলব্ধি করেন – দেশের কমপ্লায়েন্স কাঠামো অত্যন্ত জটিল। এটি যেমন বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি নতুন স্টার্টআপের জন্যও একইভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে খরচ যেমন বাড়ে, তেমনি সময় ও মানসিক চাপও বাড়ে।
দ্বিতীয় বড় বাধা হলো ফান্ডিং পাওয়া। সাধারণভাবে অনেকে মনে করেন স্টার্টআপ মানেই বিনিয়োগ পেতে সুবিধা হবে। কিন্তু বাস্তবতায় বিনিয়োগ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ‘ইনার সার্কেল’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ভালো আইডিয়া ও কার্যকর সমাধান থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় বিনিয়োগ মেলে না।
সামাজিক সমস্যা নিয়ে ভাবনার প্রেক্ষাপট
একজন মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থী হিসেবে মিলজার নিজের জীবনে অভাব ও সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়েই এগিয়ে এসেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর লক্ষ্য – যেন একজন শিক্ষার্থী অন্তত মাসে ১০০ টাকা হলেও সাশ্রয় করতে পারে। যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ হাজার শিক্ষার্থী তা করতে পারে, তবে এক বছরে তা দাঁড়াবে ১ কোটি ২০ লাখ টাকায়। এই ধারণাই তাঁকে সামাজিক দায়বদ্ধতায় অনুপ্রাণিত করে।
টিম কালচার ও নেতৃত্বের ধরন
“Your Campus” এর টিম গঠনের পেছনে মিলজার বিশ্বাস করেন, ওনারশিপ ভিত্তিক কাজ। যেখানে প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের মনে করে। কর্পোরেটের কৃত্রিম রীতিনীতির বদলে এখানে একটি খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কাজ হয়, যেখানে প্রত্যেকে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে স্বাধীনভাবে।
স্মার্ট সিটি গঠনের স্বপ্ন ও বাস্তবতা
তিনি মনে করেন, স্মার্ট সিটির ধারণা বাস্তবায়নের জন্য একক উদ্যোক্তার প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এটি হতে হবে সরকার, প্রাইভেট সেক্টর এবং উদ্যোক্তাদের মিলে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। “ধীরে ধীরে আমরা সেই যাত্রাপথে এগোচ্ছি এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, যদি আমরা সবাই মিলে কাজ করি।”
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তি গ্রহণের বাস্তবতা
তাঁর মতে, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় বেশ সহযোগিতাপূর্ণ। ক্যাম্পাসের ভিতরে বড় কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও বাইরের অবকাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতা মাঝে মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত প্রযুক্তি সাপোর্ট নিশ্চিত করা গেলে এই বাধাগুলোও কমে যাবে।
নতুনদের জন্য বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ
স্টার্টআপ শব্দটি যতই গ্ল্যামারাস মনে হোক না কেন, এটি একটি বাস্তব ব্যবসা। তাই নতুনদের উচিত ছোট পরিসরে পাইলট প্রজেক্ট দিয়ে শুরু করা। বড় কোনো পরিকল্পনা নেওয়ার আগে দেশের বাজার বুঝে উপযুক্ত প্রোডাক্ট ডিজাইন করা প্রয়োজন। শুধু বিনিয়োগের পেছনে না ছুটে পেইং কাস্টমার তৈরি করাই সফলতার ভিত্তি হতে পারে।
ছাত্রজীবন থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
ছাত্রজীবনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন মিলজার। পেশাগত জীবনে থাকাকালীন চেয়ারম্যান ডাঃ কাজীর প্রভাব তাঁর চিন্তাভাবনায় গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি শেখান- সমস্যার মধ্যেই থাকে সম্ভাবনা। সেভিংস ও বন্ধুদের সহায়তায় ব্যবসা শুরু করলেও টাকা কখনো তাঁর প্রাধান্য পায়নি। বরং সততা, ধৈর্য এবং সঠিক চিন্তাই ছিল তাঁর মূল অস্ত্র।
যদি তিনি হতেন একজন ভাইস-চ্যান্সেলর…
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে আরও সহজ, গতিশীল ও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক করার লক্ষ্যে তিনি ৩ টি উদ্দ্যোগ গ্রহণ করতেন-
১. ভর্তি, ফি প্রদান, কোর্স রেজিস্ট্রেশন, ডকুমেন্ট প্রসেস সহ সকল কিছু সম্পূর্ণ অটোমেটেড করা
২. হলগুলোর পরিবেশ উন্নয়ন করে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও আরামদায়ক আবাসন নিশ্চিত করা
৩. ক্যাম্পাসে একটি স্টুডেন্ট-ফ্রেন্ডলি দোকান চালু করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কম দামে পাবে
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
তিনি কল্পনা করেন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মোবাইলে থাকবে “Your Campus” অ্যাপ। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সিনিয়র বা শিক্ষকেরা বলবেন, “এই অ্যাপটা ডাউনলোড করে রাখো, তোমার পুরো ক্যাম্পাস লাইফে লাগবে।”
এই অ্যাপ শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থ উভয়ই সাশ্রয় করবে। যা গড়ে তুলবে একটি সাসটেইনেবল বিজনেস মডেল – শিক্ষার্থীদের জন্য, শিক্ষার্থীদের সাথে এবং শিক্ষার্থীদের নিয়েই।
মো: মিলজার রহমান এর এই যাত্রা প্রমাণ করে, সমস্যার মাঝেই লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা কখনোই স্বপ্নকে থামিয়ে দিতে পারে না। তাঁর স্বপ্ন শুধু নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনতে সহায়ক।
YSSE–এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা তাঁর মতো সাহসী, উদ্যমী এবং সমাজ সচেতন একজন তরুণ উদ্যোক্তার গল্প তুলে ধরতে পেরে। আমরা বিশ্বাস করি, এমন গল্পগুলোই আমাদের সমাজে ইতিবাচক উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয় – যেখান থেকে গড়ে ওঠে আগামীর নেতৃত্ব।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
সুদীপ্ত বণিক
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE