জেনেরেল টিক্কা খান বেলুচিস্তানে এতোবেশী গণত্যা করেছিলেন যে তার নামই হয়ে গিয়েছিল বেলুচিস্তানের কষাই, সেই বেলুচিস্তানের কষাই। টিক্কা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমি মাটি চাই, মানুষ নয়”। 

শুধু এই এক উক্তির মাধ্যমে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি যখন একজন জেনারেল এমন কথা বলে একটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন তখন সেটা ঠিক কতটা ভায়াবহ হতে পারে এবং তিনি তার কথা রাখার দিকে সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দিনের পর দিন লাগাতার আন্দোলন থামানোর নামে গণহত্যা চালিয়ে গেছেন, ময়লার ভাগারকে করেছেন লাশের স্তুপ, নদীর ঘোলা পানিকে করেছেন রক্তাক্ত লাল, নিজের বাহিনী দিয়ে ধর্ষণ করিয়েছেন পুত্রের সমনে তার মাকে, স্বামীর সামনে তার স্ত্রীকে, বাবার সমনে তার মেয়েকে ।

ঠিক সেই সময় একটা জাতি প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দ্বার প্রান্তে এসে দাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, হাসি মুখে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে এসেছে যুদ্ধের প্রান্তরে, যাদের আলাদা পরিচয় সেদিন গৌণ হয়ে গিয়েছিল, সেদিন তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল তারা বাংলাদেশী ।

২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানী বাহিনীরা আত্মসমর্পণ এর মাধ্যমে। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় । স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হয়ে গেলেও ইতিহাসের শুধু ৯ মাস নিয়েই বেশী আলোচানা করা হয় কিন্ত স্বাধীনতার আন্দোলন কি কেবল ১৯৭১ সালেই শুরু হয়েছিল নাকি তারও অনেক আগে থেকেই এর পরিকিল্পনা হচ্ছিলো সেই প্রশ্নর উত্তর জানার চেষ্টা করবো আমরা ।

নিউক্লিয়াস

এক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে সিরাজুল আলম খানের গঠন করা নিউক্লিয়াসের কথা। ১৯৬২ সালে এই গোপন সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে, যার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ। তাদের এই সংগঠনের মুল লক্ষ্য ছিল দেশের যাবতীয় আন্দোলনকে একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত করে নিয়ে যাওয়া আর সেটা হচ্ছে স্বাধীনতা। সেই সময় এই সংগঠন খুবই গোপনীয়তার সাথে কাজ করতো, এমনকি তাদের রিক্রুটিং পদ্ধতিও ছিল ভিন্ন । সেই সংগঠনে যে কেউ চাইলেই যুক্ত হতে পারতো না, তাদের মনোবল এবং দেশপ্রেমের পরীক্ষা পার করে তবেই যুক্ত হতে হতো এবং বিশ্বাস ঘাতকতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। প্রথমদিকে এটি অতি গোপনে শুরু করলেও সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য মতে ১৯৬৬ সালে এটা সম্পর্কে হাই কমান্ড তথা শেখ মুজিবর রহমান এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে জানানো হয় এবং তারা গ্রীন সিগনাল দিয়েছিলেন। সেই সময় দাদাভাই হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের ছাত্রদের মাঝে আসম্ভব জনপ্রিয়তার দরুন সে খুব সহজেই ছাত্রদের মাঝে স্বাধীনতার তত্ত্ব ছড়িয়ে দিতে পারছিলেন সেই সময় ।

অপূর্ব সংসদ

এবার কথা বলা যাক অপূর্ব সংসদ নিয়ে। আহমদ শরীফের লেখা থেকে জানা যায়, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের একসময়ের সভাপতি আবদুল আজিজ বাগমার স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে বাগমার স্বাধীনতার তিনটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’। সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। নারায়ণগঞ্জের একটি ছাত্রসভায় সমবেত সবাই শপথ নেন যে বিজয় ছাড়া কেউ নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবেন না। তারা আরও শপথ নেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে এ ধরনের উচ্চারণ এর আগে শোনা যায়নি। আবদুল আজিজ বাগমারের ভাষ্যমতে, “১৯৬২ সালে এ ধ্বনিটি বা স্লোগানটি আমিই উচ্চারণ করেছিলাম। আমি ছিলাম সভার শেষ বক্তা”। সবাই উচ্চ কণ্ঠে স্বাধীনতার পক্ষে ধ্বনি প্রদান করে।

বিভিন্ন ইশতেহার ও পুস্তিকায় তাদের সংগঠনের নাম হিসেবে সংক্ষেপে লেখা হতো ‘অপু’। তারা একটি সরকারকাঠামোও ঠিক করেছিলেন, যেমন:

রাষ্ট্রপতি: বেগম সুফিয়া কামাল

প্রধানমন্ত্রী: আবদুল আজিজ বাগমার

অপূর্ব সংসদের তৃতীয় ইশতেহারটি লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। অপূর্ব সংসদ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার ব্যাপারে এটি ছিল একটি উদ্যোগ। প্রক্রিয়াটি গোপন হলেও অনেকেই এর সম্পর্কে জানতেন।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন থিসিস

এবার আসা যাক “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন থিসিস” নিয়ে। চারিদিকের মূলধারার রাজনৈতিক স্রোতের বাইরে গিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা উদ্ভাসিত হয়ে কমরেড সিরাজ শিকদার তার সর্বহারা রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করলেন। তিনি সব রাজনৈতিক দলকে বুর্জোয়াদের ক্ষুদ্র সংগঠন মানতেন। বিপ্লবী চিন্তা চেতনা নিয়ে ১৯৬৮ সালে প্রকাশ করলেন “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন থিসিস”, সেই থিসিসে তিনি পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে অভিহিত করেন। প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে নির্ধারণ করেন, পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদীদের জাতীয় দ্বন্দ্ব। থিসিসে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানানো হয়। সেখানে তিনি পূর্ব বাংলার বিপ্লবের চরিত্র ব্যাখ্যা করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা একটি স্বাধীন শান্তিপূর্ণ নিরপক্ষে প্রগতিশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এক অর্থে তিনি তাঁর পররাষ্ট্রনীতিও ঠিক করে ফেলেন। সেই সময় তিনি দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ করার জন্য বাহিনী তৈরির কাজেও লেগে যান এবং তার নাম দেন পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সেনাবাহিনী।

উপরের ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারবো স্বাধীনতা আমরা ১৯৭১ সালে পেলেও এর মূল প্রস্তুতি তারও অনেক আগে শুরু হয়েছে। ইতিহাসের বড় শিক্ষা হচ্ছে, অতীতের ধারাবাহিকতা চর্চার মধ্য দিয়ে বর্তমানকে বুঝতে হয়। কিন্তু আমরা যদি ইতিহাসের আলোচনা থেকে এই ঘটনাগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দেই তবে আমাদের যুদ্ধ, সংগ্রাম এবং বিজয় এর ইতিহাস অপূর্ণ রয়ে যাবে। এই ঘটনা গুলো ইতিহাসে সঠিকভাবে জায়গা দিলে আমরা বলতে পরবো, হঠাৎ যুদ্ধে এ বিজয় আসেনি, এ বিজয় সুদীর্ঘ স্বাধীনতার আন্দোলনের ফল ।

আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

লেখক,

শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহী

 ইন্টার্ন,কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE