আজ থেকে হাজার বছর আগে সভ্যতার শুরুর দিকে মানুষ যখন গুহাবাসী আদিম জীবন যাপন করতো তখন তাদের জীবনে টিকে থাকাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, এরপর বহু শতাব্দী পেরিয়ে গেছে মানুষ প্রস্তর যুগ আর লৌহ যুগর শিকারি জীবন পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীর অতি আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে।
সভ্যতার এই বিবর্তনে মানবজাতি যে অতি উন্নয়ন সাধন করেছে তার প্রমাণ আমরা গত শতাব্দীর চন্দ্রজয় থেকে শুরু করে এই শতাব্দীর মঙ্গল অভিযানের দিকে তাকালেই দেখতে পারি। কিন্তু এত কিছুর মাঝে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি এখনও সকলের সমান মানবাধিকার প্রশ্নে আমাদের আশানুরূপ উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছি?
গত শতকেও নারীদের ভোটাধিকার ছিলনা, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো, ব্রিটিশ কলোনাইজার-রা ভারতীয় উপমহাদেশে নীল-চাষের নামে একপ্রকার দাসত্ব সৃষ্টি করে রেখেছিল প্রায় ১০০ বছর যা বিশ্বের মানব ইতিহাসের চরমতম মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে, কিন্তু এসবতো হাজার বছর আগের ঘটনা নয়, এসবতো আধুনিক মানব ইতিহাসেরও অংশ যা এখনও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে নতুন বোতলে পুরনো মদের মতই ব্যবহার হয়ে আসছে।
মানবাধিকার কি?
আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে, আসলে মানবাধিকার বিষয়টি কি? এই প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ বলে “মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্র” অনুযায়ী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স, নারী-পুরুষ, আর্থিক অবস্থাভেদে বিশ্বের সব দেশের সকল মানুষের, সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারগুলো হচ্ছে মানবাধিকার। এখানে উল্লেখ্য মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা, যা ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা গৃহীত হয়েছিল, এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফলাফল, এই ঘোষণার মূল লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর বিশ্বব্যাপী শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এতে ৩০টি অনুচ্ছেদে সব ধরনের মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার পার্থক্য কি?
কিন্তু জাতিসংঘের এই সর্বজনবিদিত সংজ্ঞা বাদেও প্রতিটি জাতির আশা, ভরসা, উন্নতির মাত্রা এবং জীবন যাপনের মানের উপর নির্ভর করে মৌলিক আধিকার এবং মানবাধিকার ভিন্ন হয়ে থাকে । এখানে বলে রাখা ভালো, মৌলিক আধিকার এবং মানবাধিকার দুটি ভিন্ন জিনিস, একদিকে মৌলিক অধিকারের উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রের সংবিধান আর অপরদিকে মানবাধিকারের উৎস জাতিসংঘ, মৌলিক অধিকারের পরিধি রাষ্ট্রের মাঝে সীমাবদ্ধ আর মানবাধিকারের পরিধি বিশ্বব্যাপী, মৌলিক অধিকার রাষ্ট্র চাহিদাভেদে ভিন্ন মানবাধিকার প্রতিটি রাষ্ট্রের ব্যপারে একই কথা বলে।
কিন্তু এতোকিছুর মাঝে দুটি প্রশ্নে প্রত্যেকটি দেশ একমত আর তা হচ্ছে :
১. স্বাধীনতা;
২ . ন্যায়বিচার;
মৌলিক অধিকারের পার্থক্য থাকলেও উপরোক্ত দুটি অধিকারের প্রশ্নে উন্নত কিংবা অনুন্নত সকল দেশের সকল দেশের নাগরিক একমত।
স্বাধীনতা: স্বাধীনতা মানে হলো ভয়, নিপীড়ন ও দাসত্বমুক্ত জীবন। এটি মানুষের নিজের জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাকে বোঝায়। প্রত্যেক ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য।
স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ আছে, যেমন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, আইনগত স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা ইত্যাদি । এই প্রতিটি রূপের আবার বিস্তর আলোচনা আছে, যেমন ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আলোচনা করা হয় চলাফেরা, নিজ নিজ ধর্ম পালন ইত্যাদি অধিকার নিয়ে, আবার রাজনৈতিক অধিকারে আলোচনা করা হয় ভোটাধিকার, মতামত প্রাকাশ, সরকারী চাকুরী ইত্যাদি অধিকার নিয়ে ।
এই অধিকারগুলো যদি রাষ্ট্র ঠিকভাবে জনগণেকে বুঝিয়ে দিতে না পারে তবে তার ফলাফল কি ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা আমদের নিজের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখতে পারি, সেটা ১৯৫২ সালে ভাষার অধিকারের আন্দোলন অথবা ১৯৭১ সালের ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা হালের ২০২৪ সালের সরকারী চাকুরীতে কোটা বিরোধী জুলাই বিপ্লব। প্রতিটা আন্দোলন ভিন্ন হলেও আমরা যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো সব আন্দোলনের মূলে ছিল মানুষের স্বাধীনতায় সরকার যন্ত্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ। আর সেটা আরব বসন্ত হোক কিংবা জুলাই বিপ্লব , প্রতি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষই জয়লাভ করেছে।
তবে, অনেক দেশেই এখনো বাকস্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। বিশেষ করে নির্যাতিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা প্রায়শই লঙ্ঘিত হয়। মানবাধিকার দিবস এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাইকে এই স্বাধীনতার অধিকার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ন্যায়বিচার: স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রকারান্তে একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ , একটাকে বাদ দিলে আরেকটি সম্ভব না।আইনকে বলা হয় স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ, সমাজে মানবাধিরকার প্রতিষ্ঠা কতে গেলে প্রথমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কারণ ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল আলোয় মানবাধিকারের সুপ্ত চারাগাছ বেড়ে উঠতে পারে নচেৎ তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় ।
ন্যায়বিচার হলো একটি আদর্শ সমাজের ভিত্তি। এটি বৈষম্য ও পক্ষপাতহীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে সমান সুযোগ দেয়। জাতিসংঘের মতে ন্যায়বিচার তখনই সম্ভব, যখন সমাজে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক দেশেই দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব এবং বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। মানবাধিকার দিবসের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো মোকাবিলায় সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
মানবাধিকার দিবস শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি আন্দোলন, একটি প্রতিজ্ঞা, যা আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেয় স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের মূল্য।
প্রতিটি মানুষই অধিকার নিয়ে জন্মায় এবং এই অধিকারগুলো রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। মানবাধিকার দিবস সেই দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু বারবার একটা প্রশ্ন ফিরে আসে, হোক সেটা প্যালেস্টাইনের কোন শিশুর মুখ থেকে কিংবা ইউক্রেনের কোন শিশুর মুখ থেকে, আমরা সত্যি কি মানুষ হিসেবে তাদের অধিকারের প্রশ্নের সমাধান আসছে দিনগুলোতে করতে পারবো নাকি স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচার শুধু দাবি হিসেবেই থেকে যাবে । অতএব আসুন, আমরা সবাই মিলে মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এবং একটি সমতার পৃথিবী গড়ে তুলি।
আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক,
শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহী
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE