বাংলার লোককথা আর কুসংস্কারের মিশেলে “হাত কাটা রবিন” নামটি যেন এক শিহরণময় অধ্যায়। গ্রামবাংলার রাতের গল্পগুজবে, লণ্ঠনের আলোতে যখন এই নামটি উচ্চারিত হয়, তখন শুধু শিশু নয়, বড়দের মনেও এক রহস্যময় কৌতূহল জাগে। কিন্তু রবিন কে? তার কাহিনির মূলে কী আছে—এক নিষ্ঠুর পরিণতির গল্প, না কি এক চিরন্তন বার্তা?
ড. জাফর ইকবালের এই সৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই রবিনের জীবনকাহিনি। রবিন ছিল এক গ্রামীণ প্রতিভাবান কারিগর। তার সৃজনশীলতা আর দক্ষতা এতই বিশিষ্ট ছিল যে গ্রামের লোকেরা তাকে একপ্রকার শিল্পী হিসেবেই জানত। কাঠ, ধাতু, যা-ই তার হাতে পড়ত, সেটি যেন শিল্পে রূপ নিত। তার কারুকাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর-দূরান্তে। কিন্তু প্রতিভার যেমন মূল্য আছে, তেমনি তার বিপদও কম নয়। একদিন রাজপ্রাসাদ থেকে এক শাসক রবিনকে ডেকে পাঠান। তার নির্দেশ ছিল—এক গুপ্তধন সিন্দুক তৈরি করতে হবে, যা শুধু রাজকোষের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে।
রবিনের হাতে তৈরি সেই সিন্দুক এতটাই নিখুঁত আর শক্তিশালী হয়েছিল যে শাসক আর কেউ তা খুলতে সক্ষম হবে না বলে নিশ্চিত হন। কিন্তু এখানেই শুরু হয় রবিনের জীবনের মর্মান্তিক অধ্যায়। শাসক চাননি, কেউ ভবিষ্যতে সিন্দুকের গোপন রহস্য জেনে ফেলুক। তাই তিনি রবিনের দু’হাত কেটে নেওয়ার আদেশ দেন।
গ্রামের লোকেরা এই ঘটনায় মর্মাহত হলেও রাজশক্তির ভয়ে নিশ্চুপ ছিল। রবিন বেঁচে থাকলেও, তার জীবন এক অন্ধকার অধ্যায়ে পরিণত হয়। তার হাতের শূন্যতা শুধু শারীরিক নয়; এটি ছিল তার জীবনের সম্ভাবনা আর স্বপ্নের চূড়ান্ত বিনাশ। কিন্তু এখানেই গল্প শেষ হয় না। রবিন, শারীরিকভাবে পঙ্গু হলেও, এক অনন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হন।
শোনা যায়, রাতের আঁধারে রবিনের ছায়া গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তার কাটা হাতের শূন্যতা যেন অন্যায়ের প্রতীক হয়ে ভয়ের সঞ্চার করে। যারা অন্যায় করেছে বা রাজশক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তাদের নাকি রবিনের আত্মার সামনে জবাব দিতে হয়েছে। লণ্ঠনের আলো নিভে গেলে, বা বাতাসে হঠাৎ শীতলতা নেমে এলে, গ্রামবাসীরা রবিনের উপস্থিতি অনুভব করত।
কিন্তু প্রশ্ন হল, রবিন কি শুধু একটি ভয়ের চরিত্র? না কি তার গল্পের গভীরে লুকিয়ে আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ? রবিন সেই মানুষদের প্রতীক, যারা শোষণ আর অন্যায়ের শিকার হয়েছে। তার কাটা হাত শুধুমাত্র তার শরীরের নয়, বরং তার অধিকার, তার স্বপ্ন, তার সৃজনশীলতার শিকলবদ্ধতাকে বোঝায়।
ড. জাফর ইকবাল এই গল্পের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের এক চিরন্তন বার্তা দিয়েছেন। রবিন সেই মানুষদের প্রতীক, যারা শোষণ আর অন্যায়ের শিকার হয়েছে। আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে রবিনকে দেখা যেতে পারে এক চিরন্তন বার্তাবাহক হিসেবে। তার কাহিনি আমাদের শিখিয়ে দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহার চিরস্থায়ী নয়। অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, একদিন তার শাস্তি অবশ্যম্ভাবী। রবিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিবাদের ভাষা শুধু শব্দে নয়, কখনও কখনও নিঃশব্দ প্রতীকেও প্রকাশিত হতে পারে।
গ্রামের প্রবীণেরা আজও রবিনের গল্প বলেন, তবে তার রূপ পাল্টেছে। এটি কেবল এক ভয়ের কাহিনি নয়; এটি আমাদের ন্যায়বিচার আর মানবিকতার প্রশ্নে ভাবতে শেখায়। গল্পটা যতবারই শোনা হোক, প্রতিবার নতুন অর্থ নিয়ে আসে। ছোটদের জন্য এটি ভয়ের গল্প, কিন্তু বড়দের জন্য এটি এক চেতনার প্রতীক।
তাহলে, রবিন কি কেবল এক লোককথা, না কি অন্যায় আর ন্যায়বিচারের চিরন্তন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি? হয়তো উত্তরটি খুঁজে পাওয়া যাবে তার গল্পের গভীরে, যেখানে ভয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে সাহস আর প্রতিবাদের এক অনন্য বার্তা।
হাত কাটা রবিন শুধু এক চরিত্র নয়; তিনি এক চিরন্তন প্রতীক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবতার পরিচয়। তার গল্প ভয়ের চেয়ে বেশি, এটি সাহস জোগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্র শেখায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু হয়, তা কখনোই বৃথা যায় না—এই বার্তাটিই যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলেছেন রবিন।
ড. জাফর ইকবালের অসাধারণ রচনায় “হাত কাটা রবিন” আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামই প্রকৃত মানবতার পরিচয়।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক,
জেমি সাইলুক
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE