শৈশবে প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যবই তে পড়া “হনহন পনপন” ছড়া তোমাদের মনে পরে? কিংবা “রামগরুড়ের ছানা” অথবা “বাপুরাম সাপুড়ে” ছড়ার লাইনগুলি? এই ছড়াগুলো আমাদের শৈশবের একটা ছন্দময় অংশ ছিল, তাইনা? 

বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে হাস্যরসের ছড়া এক অন্যতম জনপ্রিয় ধারা। এই ধারার অন্যতম প্রবর্তক হলেন সুকুমার রায়। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের “ছন্দের জাদুকর” ও বলা হয়। তাঁর লেখা ছড়াগুলি শুধু শিশুদের হাসাতে বাধ্য করে না, পাশাপাশি তাদের মনে চিন্তার খোরাকও জোগায়।

সুকুমার রায় (৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) ছিলেন একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স ছড়া”র প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তার পুত্র খ্যাতিমান ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তার লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হ-য-ব-র-ল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা “ননসেন্স” ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ধ্রুপদী সাহিত্যই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর শত বর্ষ পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম একজন।

ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছড়া অন্যতম। খেতে বসে কিংবা ঘুমানোর আগে বায়না ধরলে আমাদের মা-বাবা আমাদের মন ভুলাতেন বিভিন্ন ছড়া শুনিয়ে। এমনকি স্কুলের পাঠ্যবই থেকেও আমরা নানান রকম ছড়া শিখতে পারতাম। এভাবেই আমরা আমাদের ছন্দের জাদুকরের সাথে পরিচিত হই। এবং তাঁর জাদুকরী ছড়াসমূহ আমাদের শৈশবের অংশ হয়ে ওঠে।

সুকুমার রায়ের অন্যতম বিখ্যাত কবিতার বইঃ

আবোল তাবোলঃ 

আবোল তাবোল সুকুমার রায়ের বিখ্যাত “নন্‌সেন্স” সংকলন। এটি ১৯২৩ সালে ইউ রায় এন্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হয়। এই সংকলনে মোট ছড়ার সংখ্যা ৫০টি, যার মধ্যে ৭টি বেনামে লেখা হয়েছে। এবং তিনি এটি বাবু সমাজ কে সমালোচনা করার জন্য লিখেছিলেন। এটির দ্বারা তিনি গান্ধীজির অহিংসা সত্যাগ্রহ নীতির বিরোধিতা করেন। ছোটদের উদ্দেশ্যে লেখা সুকুমার রায় কবিতাগুলির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আবহের প্রচ্ছন্ন রূপ। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে লেখা কবিতাগুলি আজও বাংলা তথা বাঙালি মনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বেঁচে আছে।

আবোল তাবোল গ্রন্থের কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতাঃ

  • ভয় পেয়ো নাঃ

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না—

সত্যি বলছি কুস্তি ক’রে তোমার সঙ্গে পারব না ।

  • ন্যাড়া বেলতলায় যায় ক’বার:

লেখা আছে পুথিঁর পাতে, ‘নেড়া যায় বেলতলাতে’,

নাহি কোনো সন্ধ তাতে – কিন্তু প্রশ্ন ক’বার যায়?

  • সৎ পাত্রঃ

শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে—

তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?

গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?

জানতে চাও সে কেমন ছেলে ?

  • রামগরুড়ের ছানা:

রামগরুড়ের ছানা  হাসতে তাদের মানা,

হাসির কথা শুনলে বলে,

“হাসব না-না, না-না!”

  • আহ্লাদীঃ

হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী,

তিনজনেতে জট্‌লা ক’রে ফোক্‌লা হাসির পাল্লা দি।

  • বাবুরাম সাপুড়েঃ

বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস্‌ বাপুরে?

আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা—

এমনই আজগুবি, উদ্ভট, অসম্ভব রশে পরিপূর্ণ আমাদের জাদুকরের ছড়া। ‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের ভূমিকায় সুকুমার রায় নিজেই লিখেছিলেন, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাহাঁদের জন্য নহে।’

সুকুমার রায়ের কবিতার বিশেষত্বঃ

কবি সুকুমার রায়ের কবিতার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো খুব সহজ ভাষায় আমাদের জীবনের কঠিন সত্যিগুলো উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি চরিত্র বড্ডো জীবন্ত। তাঁর ছড়াগুলি হাস্যরসের এক অফুরন্ত খনি। তিনি অদ্ভুত কল্পনা, অপ্রত্যাশিত ঘটনা এবং মজার শব্দচয়ন করে শিশুদের হাসাতে বাধ্য করতেন। তাঁর ছড়াগুলি শুধু হাস্যরসপূর্ণই ছিল না, পাশাপাশি শিক্ষামূলকও ছিল। ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে তিনি শিশুদের নানা বিষয় শিখিয়েছেন।

সুকুমার রায়ের ছড়াগুলি আজও শিশুদের মনে আনন্দ দেয়। তাঁর ছড়াগুলি শুধু শিশুদের জন্যই নয়, বড়দের জন্যও আনন্দের উৎস। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যে এক অমূল্য অবদান রেখে গেছেন।

এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

লেখিকা

খোশবুবা আলম ব্রতী

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE