হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই ২০১২) শুধু একটি নাম নয়, হুমায়ূন আহমেদ আসলে একটি জগত। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদ। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে সাধারণের মধ্যেও অসাধারণকে খুঁজে নিতে হয়, কীভাবে তুচ্ছ ঘটনাও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাঁর লেখার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে এমন এক রূপকথা, যা আমাদের পরিচিত বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, যেখানে যুক্তি হার মানে হৃদয়ের কাছে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস নন্দিতো নরোকে ছিল তাঁর সাফল্যের শুরু।
তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার কাজগুলি অহিংসা, বাস্তববাদী গল্প, পারিবারিক নাটক এবং হাস্যরসের ধরণ দ্বারা চিহ্নিত। তিনি আমাদের সংস্কৃতি, পৌরাণিক কাহিনী এবং ঐতিহ্যের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল এবং প্রকৃতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা তাঁকে গ্রামকেন্দ্রিক করে তুলেছিল। তাঁর অনেক বক্তৃতায় তিনি গ্রামীণ মানুষের গল্প বর্ণনা করেছেন, সততার সন্ধানে নগর জীবনের ব্যস্ততা এড়িয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে গ্রামের মানুষের চরিত্রের মধ্যে যে সততা উপস্থিত, তা শহুরে মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত। নুহাশ পল্লীই এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। হুমায়ূন আহমেদ দুই শতাধিক বই লিখেছেন। অবশ্যই তার সমস্ত উপন্যাস বা বক্তৃতা সাহিত্যিক মূল্য অর্জন করতে পারেনি কেননা এটা সত্য যে একজন লেখক তার সমস্ত কাজের জন্য পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করতে পারেন না, বরং তার উল্লেখযোগ্য কিছু কাজই এটা সম্ভব করে।
আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন পাঠকরা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাদের সমসাময়িক লেখকদের সাহিত্যকর্ম ছাড়া বাংলা উপন্যাস পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, তখন হুমায়ূন আহমেদই এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন। পাঠকরা তাঁর গল্প বলার অনন্য ধরণ, যা আমাদের মৌখিক ঐতিহ্যের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ, যার কারনে তার গল্প পড়তে বাধ্য হন। হুমায়ূন আহমেদ নন্দিতো নরোকে, জ্যোৎস্না জননির গল্প, বাদশা নামদার, দেওয়াল, মধ্যাহ্ন, হিমু এবং মিসির আলী সিক্যুয়াল ইত্যাদির মতো সৃষ্টির জন্য বিখ্যাত। বাদশা নামদার, ইতিহাসের উপর ভিত্তিকৃত একটি উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ সফলভাবে প্রমাণ করেছেন যে ইতিহাসকে প্রধান উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেও একটি উপন্যাস লেখা সম্ভব। তিনি একটি অনন্য, সরল সাহিত্যিক বাচনভঙ্গির মাধ্যমে নিজেকে আলাদা করেছেন যা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর গল্পগুলি প্রায়শই বাস্তবতার সাথে অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলিকে মিশ্রিত করে।
১৯৯০ সালে হুমায়ূন আহমেদ তার “ময়ূরাক্ষী” উপন্যাসে হিমু (হিমালয়) চরিত্রটি তৈরি করেন এবং এই চরিত্রটি বাংলাদেশী সাহিত্যে একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে। তার গল্পগুলোতে আমরা এমন এক জগতে প্রবেশ করি, যেখানে আকাশ ভরা তারার নিচে হিমু হেঁটে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীনভাবে, হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে। তার উদাসীনতা যেন এই জগতের গতানুগতিক নিয়মের প্রতি এক নীরব বিদ্রোহ। আবার শুভ্র আসে তার রহস্যময় হাসি নিয়ে, যার চোখে যেন লুকিয়ে থাকে কোনো অজানার ইশারা। তারা আমাদের চেনাজানা জগতের মানুষ, অথচ তাদের মধ্যে এমন কিছু আছে যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, যা বাস্তবতার কঠিন বাঁধনকে আলগা করে দেয়। ভাবুন তো, মধ্যরাতে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে একটি পুকুরের পাড়ে বসে আছেন কেউ, আর হঠাৎ জলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে অচেনা সুর। কিংবা কোনো নির্জন দুপুরে, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে যেন কোনো দূর দেশ থেকে ভেসে আসছে কোনো গোপন বার্তা। হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলো ঠিক এমনই – আমাদের অতি পরিচিত জীবনে তারা এক অলৌকিকতার ছোঁয়া দিয়ে যায়।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকৃত চরিত্রগুলি ঠিক এমনি মানব প্রকৃতির বিভিন্ন দিক অন্বেষণ করে এবং পাঠকদের মধ্যে একধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করে, যা এই চরিত্রগুলোকে বাংলা সাহিত্যে চিরকাল জীবন্ত করে রাখে। ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে প্রতি বছর একুশে বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বইগুলি সর্বাধিক বিক্রিত হয়েছে। নাটক সিনেমায় ও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি নব্বই এর দশকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নাট্যকার ছিলেন, তাঁর কাজ, যেমন কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, এবং বহুব্রীহি, এখনও ভক্ত এবং সমালোচকদের দ্বারা মাস্টারপিস হিসাবে বিবেচিত হয়, তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবেও আবির্ভূত হন। তিনি মোট আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন – প্রতিটি তার উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল: দারুচিনি দ্বীপ, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, শঙ্খনীল কারাগার, দুই দুয়ারি, শ্যামল ছায়া এবং ঘেটুপুত্র কমলা। অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রের জন্য তিনি পরিচালনা, চিত্রনাট্য এবং গল্পের জন্য রেকর্ড সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৪ সালে বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদকও জিতেছেন।
আমরা সকলেই জানি যে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর জীবদ্দশায় তার অনেক রচনার জন্য কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু ভবিষ্যতে কি হুমায়ূন আহমেদকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা সম্ভব হবে? অবশ্যই না। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের দেখিয়েছেন যে বাস্তবতা কেবল সেইটুকুই নয় যা আমরা চোখে দেখি বা যুক্তিতে বুঝি। এর বাইরেও এক বিশাল জগত আছে, যা আমাদের কল্পনা আর অনুভূতির মাধমে অনুভব করতে হয়। তাঁর গল্পগুলো সেই জগতের দরজা খুলে দেয়, যেখানে বাস্তবতাও হার মানতে বাধ্য হয়।
হুমায়ূন আহমেদের রূপকথার জগৎ আমাদের শিখিয়ে যায়, যতক্ষণ আমাদের হৃদয়ে কল্পনার রঙ অক্ষুণ্ণ থাকে, ততক্ষণ বাস্তবতা যতই ধূসর হোক না কেন, রূপকথার আলোয় তা ঝলমল করতে বাধ্য।
এইরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখক,
ঈষিতা তাবাসচ্ছুম মৌ,
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE