একটি ভালো গল্প বা কবিতা শিশুদের কল্পনা শক্তি এবং চিন্তাভাবনাকে প্রসারিত করে। এছাড়াও শিশুসাহিত্য কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি শিশুদের মানসিক বিকাশ, নৈতিক মূল্যবোধ এবং সৃজনশীলতা গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যুগে যুগে বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিকদের সংখ্যা ও কম নয় যারা নিজেদের কলমের চালনার মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। আজ আমরা এমন ১০ জন শিশুসাহিত্যিক এর জীবনী সম্পর্কে জানবো যারা ফুলের মতো কোমল শিশুদের ভালোবেসে তাদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন এবং পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে ( ৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছদ্মনাম ছিলো “ভানুসিংহ ঠাকুর” (ভণিতা)।
শিশুদের জন্য তার রচিত বিখ্যাত সাহিত্যগ্রন্থগুলো হলো : শিশু, শিশু ভোলানাথ, খাপছাড়া, ছড়া, ছড়া ও ছবি, ছুটি, গল্প – স্বল্প – কল্পনা, সহজপাঠ, ছেলেবেলা, বিশ্বপরিচয়, লিপিকা, মুকুট, পরিচয়, পোস্টমাস্টার, বলাই, ইচ্ছেপূরণ, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ইছামতী নদী প্রভৃতি। এছাড়াও কড়ি ও কোমল, কাহিনী, চিত্রা, ক্ষণিকা, কল্পনা, লেখন, সোনার তরী প্রভৃতিতেও ছোটদের জন্য রচয়িত অসংখ্য গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও তার বিখ্যাত গল্প “ কাবুলিওয়ালা ” নিয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিখ্যাত গল্প “ ডাকঘর ” নিয়ে নাটক নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও আমাদের ছোট নদী, আষাঢ়, বীরপুরুষ, মাঝি, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, দুই পাখি, দুই তীর, তালগাছ, ছুটি, অকর্মার বিভ্রাট, ছোটোবড়ো প্রভৃতি এসকল বিখ্যাত কবিতাগুলো যুগে যুগে শিশুদের মুখে পঠিত হচ্ছে।
তিনি ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে ( ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় নিজ বাসভবনে পরলোকগমন করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম :
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সালে ( ২৪ শে মে ১৮৯৯) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছদ্মনাম ছিলো “ধূমকেতু ”।
তিনি প্রধানত বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন দুই হাত ভরে। তার রচিত লিচুচোর, প্রভাতি, আমি হব, সংকল্প, খুকী ও কাঠবেড়ালি,খাদু দাদুর ছড়া, ঝিঙে ফুল, শিশু জাদুঘর, সাত ভাই চম্পা প্রভৃতি এইসকল ছড়াগুলো শিশুদের কাছে অনেক জনপ্রিয়।
এছাড়াও আরও বিখ্যাত শিশুসাহিত্য হচ্ছে : ঝিঙে ফুল, পুতুলের বিয়ে, সঞ্চায়ন, পিলে পটকা – পুতুলের বিয়ে, ঘুম জাগানো পাখি, ঘুম পাড়ানী মাসি পিসি, সাত ভাই চম্পা, ফুলে ও ফসলে, ভোরে পাখি, তরুণের অভিযান, মটকু মাইতি, জাগো সুন্দর চির কিশোর, ঝিলিমিলি , সেতুবন্ধন, ভূতের ভয় প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি পদ্মগোখরো, জিনের বাদশা, অগ্নিগিরি নামক তিনটি গল্প রচনা করেছেন যা শিউলিমালা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এদের মধ্যে জিনের বাদশা, অগ্নিগিরি নামক গল্পে কবি নজরুলের কৈশোর জীবনের স্মৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তিনি ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ ( ১৯৭৬ সালে ২৯ শে আগস্ট) ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাংলাসাহিত্যিক এর আরেক বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের পিতা এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা। তিনি ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭ শে বৈশাখ ( ১৮৬৩ সালের ১০ই মে) কিশোরগঞ্জ জেলার মসূয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ছাত্র অবস্থায় থাকাকালীন তিনি শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা শুরু করেন। গুপি – গাইন – বাঘা – বাইন, টুনটুনির বই তার অমর সৃষ্টি। এছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য হলো : চড়ুইয়ের বুদ্ধি, টুনটুনির বুদ্ধি, বোকা কুমিরের কথা, টুনটুনি আর নাপিতের কথা, ছেলেদের মহাভারত, বাঘ মামা আর শিয়াল ভাগ্নে, কুজোঁ বুড়ির কথা, বোকা বাঘ, ছেলেদের রামায়ন, হাতির ভিতরে শিয়াল, কুজোঁ আর ভূত, ভুতো আর ঘোঁতো, পান্তা বুড়ির কথা, টুনটুনি ও রাজার কথা, বাঘখেকো শিয়ালের ছানা, পিপঁড়ে আর পিপঁড়ীর কথা, মহাভারতের কথা, উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র প্রভৃতি অজস্র শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন।
তিনি ১৯১৫ সালে ২০শে ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
সুকুমার রায়
জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক কবি সুকুমার রায় ১৮৮৭ সালে ৩০ই অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাকে ভারতীয় সাহিত্যে “ ননসেন্স রাইমের ” প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তার ছদ্মনাম ছিলো “উহ্যনাম পণ্ডিত ”।
তিনি শিশুদের জন্য অসংখ্য জনপ্রিয় ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। যেমন: বাবুরাম সাপুড়ে, কাতুকুতু বুড়ো, নূতন বছর, শ্রাবণে, ডানপিটে, ঠিকানা, চোর ধরা, এক বছরের রাজা, পালোয়ান, অসিলক্ষণ পণ্ডিত, গন্ধ বিচার, বোম্বাগড়ের রাজা, পাকাপাকি, বুড়ীর বাড়ী, ছায়াবাজী, কাজের লোক, অসম্ভব নয়, বুঝিয়ে বলা প্রভৃতি।
এছাড়াও আরো বিখ্যাত বই রচনা করে তিনি অমর হয়ে আছেন। যেমন: হ-য-ব-র-ল, ছড়া সমগ্র, আবোল তাবোল, কমিক্স : পাগলা দাশু, অবাক জলপান, ছাতার মালিক, পুতুলের ভোজ, ছোটদের বিজ্ঞান জগৎ, কার দোষ?, ডিটেকটিভ, এক বছরের রাজা, ছড়া ও কবিতা সমগ্র, বহুরুপী, শিশু-কিশোর বিজ্ঞান, গল্পের ঝুলি, জানতে হলে পড়তে হবে, খাই খাই, সন্দেশের গল্প প্রভৃতি।
আড়াই বছর কালাজ্বরে (লেইশ্মানিয়াসিস) ভুগে তিনি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১০০ গড়পাড় রোডের বাড়িতে পরলোকগমন করেন।
মোহাম্মদ নাসির আলী
মোহাম্মদ নাসির আলী ১৯১০ সালে ১০ই জানুয়ারী বিক্রমপুর বর্তমান মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে ধাইদা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছদ্মনাম ছিলো “বাগবান ”।
তিনি ছোটদের জন্য রচয়িত উল্লেখযোগ্য সাহিত্য হলো : আকাশ যারা করলো জয়, লেবুমামার সপ্তকাণ্ড, ভিনদেশী এক বীরবল , আলিবাবা, একটি গোয়েন্দা কুকুরের কাহিনী, বীরবলের খোশগল্প, সাত পাঁচ গল্প, চীনদেশের রাজকুমারী, কিশোর অ্যাডভেঞ্চারত্রয়ী, সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, টলস্টয়ের সেরা গল্প, ছোটদের আরব্য রজনীর গল্প, বোকা বকাই, তিমির পেটে কয়েক ঘন্টা, বিক্রমপুরের পোড়ো রাজা, ছোটদের মোহাম্মদ বিন কাসেম, ছোটদের বাদশাহ আলমগীর, ছোটদের ওমর ফারুক, ছয় দ্বিগুণে বার, আলিফ লায়লার গল্প, সোনার চরকা প্রভৃতি।
এছাড়াও তিনি অনেক বিদেশী লেখকের বইয়ের ভাষান্তর হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪০টির অধিক। শিশুসাহিত্যে অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি শিশুসাহিত্যের উপর প্রবর্তিত অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
তিনি ১৯৭৫ সালে ৩০ শে জানুয়ারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
শিশুদের শিক্ষণীয় বার্তা প্রদানে শিশুসাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। পর্ব-২ এ আমরা এমন আরো কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকের জীবনী সম্পর্কে জানবো, যাদের সাহিত্যকর্ম শিশুদের মানসিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা রেখেছে।
(চলবে)
আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকা
অশীন বিনতে জামাল
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE