১৬ই ডিসেম্বর,প্রত্যেকটি বাংলাদেশীর জন্য এক অসম্ভব গৌরবের দিন।পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে মুক্ত আকাশে ওড়ার অধিকার ছিনিয়ে আনার দিন।পৃথিবীর বুকে এক নির্যাতিত জাতির অবিশ্বাস্য ইতিহাস গড়ার দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছিলো, বাঙালি জাতি পরাজয় বরন করার জাতি নয়।কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যথার্থই লিখেছেন,

“সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী

অবাক তাকিয়ে রয়

জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার

তবু মাথা নোয়াবার নয়।”

আমাদের শির উন্নত রেখেছেন আমাদের পূর্বজরা। তাঁরা আমাদের হারতে দেননি। সাড়ে তিন লাখ নারীর সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ শহিদের জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা পেয়েছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হন নি, পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদেরও নিজস্ব ছোট্ট একটা জায়গা তৈরি করে নিতে তাদের ত্যাগ আর আত্মউৎসর্গের কাব্যগাঁথা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও সংগ্রাম

বাঙালি তথা বাংলাদেশীদের নিজ অধিকারের জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ পুরনো। ৪৭ এ দেশ ভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও, পাকিস্তানের দু’টি অঞ্চলের মধ্যে অমিল যেন ছিল চোখে পড়ার মতো। সংস্কৃতি,ভাষা,রাজনৈতিক মতাদর্শ সব কিছুতেই আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ব্যবধানের ব্যপারটা প্রকট হয়ে গেলো যখন পাকিস্তান, (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ আচরণ ও অবহেলা করতে শুরু করলো।

প্রথম আঘাত টাই তারা করেছিলো আমাদের ভাষার উপর। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে নেমে আসা ছাত্র আন্দোলন দিয়ে শুরু হয় আমাদের অধিকারের লড়াইয়ের। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে নেমে আসা ছাত্রের ঢলে গুলি করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী আমাদের বুঝিয়ে দেয় তাদের নজরে আমাদের অবস্থান, আর কেনই বা আমাদের নিজেদের জাতিগত স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে আলাদা হওয়া জরুরী। ৫২ এর পরবর্তী সময়গুলোতেও তাদের আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি বাঙালি জাতির প্রতি। যা ধীরে ধীরে বাঙালির বুকে ক্রোধের দাবানলে রূপ নেয়।

নানা আন্দোলন ও নাটকীয়তায় ৪৭ থেকে ৬৯ এর বছরগুলো পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ছিলো বেশ উত্তপ্ত। এরপর এলো ৭০ সালের নির্বাচন। পাকিস্তানের ক্ষমতাধরদের অহংকার ও আত্মগরিমার চূড়ান্ত হলো যখন তারা বিজয়ী দল আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানালো। তারা কখনোই মানতে পারছিলো না যে একজন বাঙালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ফলাফল স্বরূপ, দুই পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠে।

২৫শে মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তরসহ যাবতীয় বিষয় নিয়ে বৈঠকের কথা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের কথার বরখেলাপ করে। এবং সেই রাতেই ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের উপর নারকীয় হামলা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই রাত বাঙালির ইতিহাসে গণহত্যার ‘কালরাত্রি’ নামে পরিচিত। এখানেই সূচনা হয় বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রামের।

বাংলাদেশের আপামর জনতার অদম্য মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন আমাদের দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতার সংগ্রামে হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্ত

১৬ ই ডিসেম্বর,১৯৭১। দীর্ঘ নয় মাসের তুমুল লড়াইয়ের পর অবশেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজয় বরন করে। এবং রমনার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য একসাথে আত্মসমর্পণ করে।

বিজয় কখনো রুপোর থালায় পরিবেশন করা হয় না। বিজয় অর্জন করতে হয়। দীর্ঘ ২৩ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন, সংঘাত আর নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলাফল বাংলাদেশের এই অর্জন। কোটি মানুষের অপেক্ষা, লাখ মানুষের আত্মত্যাগ আর সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই বিজয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাস, এক নিপীড়িত, নিগৃহীত তবে অদম্য আত্মসম্মানী ও দেশপ্রেমিক জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। যা যুগ যুগ ধরে হাজারো নিপীড়িত জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করে আসছে।

ত্যাগ এবং সংগ্রামের চিত্র

দীর্ঘ নয় মাসের এই যুদ্ধে পাকিস্তানের হায়না বাহিনীর সাথে সমান তালে একতাবদ্ধভাবে অসীম লড়াই লড়ে গেছেন আমাদের দেশের নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সকলে। প্রতিটা জেলা, শহর, গ্রাম সর্বত্রই এই লড়াই চলেছে।ট্রেনিংপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনীর যোদ্ধারা গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন মুক্তিকামী সাধারণ জনতাকে।অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত পাক হানাদার বাহিনীর সাথে অসম এই লড়াইয়ে হারিয়েছি আমরা অনেক কিছুই।প্রিয়মুখ,প্রিয়জন,শেষ সম্বল সব কিছুই উৎসর্গ করেছে এই দেশের আপামর জনতা স্বাধীনতার নামে।তবেই তো পেয়েছি রক্তে লেখা স্বাধীনতা আর রক্তে গড়া এক টুকরো ছোট্ট দেশ।

এই জয় অদম্য চেতনার, এই জয় আত্মমর্যাদার।

বিজয় দিবসের অঙ্গীকার

বিজয় দিবস কি কেবলই ৭১ এর যুদ্ধের ফলাফল?ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এর থেকে কি বার্তা নেয়ার আছে কখনো কি মনে এসেছে এই প্রশ্ন?

বিজয় দিবস যে কেবল একটা দিন নয়। এর তাৎপর্য তো বহুত। এটি আমাদের অতীতকে আবার স্মরণ করার দিন। জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করার দিন। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের শেখায় যে, একটি জাতির মুক্তির জন্য কেবল সাহসী লড়াই যথেষ্ট নয়। বরং এরই সাথে থাকতে হবে কষ্ট, ত্যাগ সহ্য করার মানসিক প্রস্তুতি।এক দীর্ঘ ও অনিশ্চিত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় থাকতে হবে। একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এই বিজয় পেতে। একে পেতে উৎসর্গ করতে হবে অনেক কিছু,হয়তো নিজের সর্বস্ব। সৎ থাকতে হবে,লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে।

সর্বোপরি,আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেয়া সকল বীরযোদ্ধা ও শহীদদের ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। একটি গণতান্ত্রিক, সমতা ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক দেশ গঠনে আমাদের সকলকে একতাবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তবেই তাঁদের ত্যাগকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।

১৬ ডিসেম্বর,২০২৪। বাংলাদেশের ৫৩ তম বিজয় দিবসে আমাদের শপথ হোক, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার। আমরা এক দেশ ,এক জাতি হয়ে থাকবো। তবে,অন্য জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবো। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি বিনয়ী মনোভাব রাখবো। দেশের ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে সদা প্রস্তুত থাকবো।

সবশেষে, মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু, বিজয় আমাদের হবেই!

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন

লেখক,

হুমায়রা ইয়াসমিন 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE