“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়

ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে- পায়ে”। 

স্বার্থ বনাম যৌক্তিককতার লড়াইয়ে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। 

প্রথম ধাপ : নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি ও অনাসৃষ্টির সূত্রপাত। 

জুন, ১৯৪৭ :

সাপ্তাহিক পত্রিকা “মিল্লোতে” সম্ভাব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে করার পক্ষে মত দেওয়া হয়।

জুলাই, ১৯৪৭ :

জুন ও জুলাই মাসে আবদুল হক একাধিক কলামের মাধ্যমে তাঁর বিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে বাংলাকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া উচিত।

অন্যদিকে, মুসলিম লীগ এবং মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে এবং বাইরে উর্দুভাষী ব্যক্তিরা, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মনোনীত করার পক্ষে মত দিতে থাকেন।

এক সম্মেলনে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ তার বিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে একটি মুসলিম জাতির,  একচেটিয়াভাবে উর্দুকে সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং বিশিষ্ট ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন।

২৯ জুলাই, ১৯৪৭ এ  “পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা” শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায়  ড. জিয়াউদ্দীন আহমদের মতামত খন্ডন করে যুক্তি উপস্থাপন করেন, নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৫৫ ভাগের মুখের ভাষা বাংলা হওয়ায়, বাংলাই হওয়ার দাবিদার।

বাংলাকে প্রথমে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে অত:পর উর্দুকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে বিবেচনা করা হোক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

আগস্ট, ১৯৪৭ :

১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ (ডিওয়াইএল) নামে একটি দল গঠন করে।

উর্দু ভাষার প্রতি পক্ষপাতের মতো সরকার যা করছে তাতে তারা একমত ছিল না। তাই, তারা এই অন্যায় কর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার এবং প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ :

শিক্ষাবিদ, লেখক ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে সংগঠিত তমুদ্দিন মজলিস  বুকলেট বের করে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা:বাংলা না উর্দু?” শিরোনামে।

এটির গ্রন্থকার আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল কাসেম এবং কাজী মোতাহার হোসেন পূর্ব পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে একমাত্র বাংলা ব্যবহারের জন্য গুরুত্বারোপ করেন।

নভেম্বর, ১৯৪৭ :

করাচিতে শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে “পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন” এ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

দ্বিতীয় ধাপ : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার ঘটনাক্রম। 

জানুয়ারি, ১৯৪৮ :

বাংলা ও বাঙালীর অধিকার আদায়ে সচেষ্ট সংগঠন Pakistan Student’ League(EPSL) গঠন করা হয় ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮।

ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ :

২৩শে ফেব্রুয়ারী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব দেন পূর্ব বাংলার কুমিল্লার সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত  সংবিধান গঠনের প্রথম অধিবেশনে।

মার্চ, ১৯৪৮ :

ডান, বাম ও মধ্যপন্থীদের সমন্বয়ে “রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয় ২রা মার্চ,১৯৪৮। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম গনবিক্ষোভ হয় ১১ মার্চ।

পাকিস্তানের তৎকালিন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ঘোষণা করেন,

“State language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Any one who tries to mislead you is really an enemy of Pakistan “

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তৎখনাত এর সমবেত প্রতিবাদ জানায়।

জানুয়ারি, ১৯৫২ :

খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টনের এক জনসভায়, ২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২, আলী জিন্নাহর অনুরুপ উক্তি করেন। এর পর দিন, ২৮ জানুয়ারি, এক প্রতিবাদ সভায়  ও মূখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।

পাকিস্তান স্টুডেন্টস লীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ এবং সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম কাউন্সিলের  আহ্বানে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়।

ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ :

২১শে ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২।

২০শে ফেব্রুয়ারী এই কর্মসূচি প্রতিরোধে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় ফকির সাহবুদ্দিনের সভাপত্বিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ : 

সকাল ১১:৩০ টা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল এর হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান দিতে থাকে।

সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশ্য বক্তৃতা দেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সম্পদাক শামসুল হক। 

সিদ্ধান্ত হয় আব্দুস সামাদ আজাদের পরিকল্পনা অনুসারে দশ জন করে মিছিল করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে।

শান্তিপূর্ণ এই মিছিলে হামলা করে পুলিশ। ছাত্ররা ইট মেরে পুলিশের টিয়ারগ্যাসের জবাব দেয়। 

জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বেলা ৩টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলের বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র, নিরীহ ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করে। রাজপথ রঞ্জিত হয় শহিদদের রক্তে। হাজারো ভাষা আন্দোলনকারীদের লাল রক্তে সিক্ত হয় বাংলার মাটি।

ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ :

ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জরো হয় অসংখ্য বাঙালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। উপস্থিত জনতা মিছিল করার চেষ্টা করলে গুলি চালায় পুলিশ, যেখানে চারজন নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন অবশেষে নতি স্বীকার করে সংবিধানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

অবশেষে ৭ মে ১৯৫৪ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম পাকিস্তানের সংবিধান পাশ হয় ২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৬

এরকম আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন‌। 

লেখিকা

যারীন আনান তানহা

ইন্টার্ণ, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE