কলকাতা শহরের ঘোষ পাড়ার দম দম রোড। যেখানে অবস্থিত ছোট একটি ক্যাফে।  নাম তার অপরচুনিটি ক্যাফে। রোজকার ন্যায় আজও কাজ করছে শ্যামল। কাস্টমারদের সন্তুষ্টির  জন্য খুশিমনে নিজের কাজ এ নিয়োজিত এই তরুন।  শ্যামল আর বাকি আট দশজন এর মতো নয়। এক  বছর আগেও যে ছেলেটা ঠিক মত কথা বলতে পারতো না আজকে সেই শ্যামল স্পীচ থেরাপির মাধ্যমে কাস্টমারদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম। এই ছোট ক্যাফেতে এইরকম শ্যামল এর ন্যায় আরো অনেকেই আছেন  যারা সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলেও এখানে দিব্বি নিজের মতো কাজ করতে পারেন।

অপর্চুনিটি ক্যাফে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রেসকিউ এন্ড রিলিফ ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে। দমদম রোড এ মেট্রো স্টেশন থেকে কাছেই অবস্থিত এই ক্যাফে। কলকাতা শহরের বাকি নামি দামি ক্যাফের সাথে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে এই ক্যাফে। মুখরোচক বিভিন্ন খাবার যেমন পাস্তা, চিকেন স্যান্ডউইচ, ভেজ  চিজ ম্যাগি থেকে শুরু করে চিকেন র‍্যাপ সবই পাওয়া যায় এখানে।

বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ যারা সমাজে অবহেলিত, অত্যাচারিত, যাদেরকে সমাজ দূরে ঠেলে দিয়েছে তাদের নিয়েই এই অপরচুনিটি ক্যাফে। এই অপরচুনিটি ক্যাফে পরিচালনা করে ১৬ জন সক্ষম ছেলে মেয়ের একটি দল যার মধ্যে ৯ জন স্পেশাল চাইল্ড, ৫ জন ট্রাফিকিং ভিক্টিম, ২ জন দুর্বল শিশু (সেরিব্রাল পালসি)। স্পেশাল চাইল্ড হলেই যে সমাজের বোঝা মানুষের এমন চিরচেনা ধ্যান ধারণা পাল্টে যাবে এই ক্যাফেতে গেলে।

এই ক্যাফের মালিক সিদ্ধার্থ ঘোষ। যিনি পেশায় একজন আইনজীবী। তিনি ক্যাফে ছাড়াও ‘নিউ এজ সোসাইটি’ নামে একটি হোম পরিচালনা করেন যেখানে বর্তমানে ৫৭ জন বাচ্চা রয়েছে। এদের মধ্যে অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউনফল সিনড্রোম, ট্রাফিকিং থেকে উদ্ধারকৃত শিশুরা আছে। সরকারি নির্দেশনা মতে ১৮ বছরের পর কোনো শিশুকে হোমে রাখা যাবে না কিন্তু তাই বলে তো এই অবুঝদের রাস্তায় ফেলে রাখা যায় না এই চিন্তায় তিনি বিশেষভাবে সক্ষম এই ছেলেমেয়েদের জন্য অপরচুনিটি ক্যাফে খোলেন যাতে এই ছেলেমেয়েরা আত্মনির্ভরশীল হতে পারে।

অপরচুনিটি ক্যাফেতে কাজ করা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কর্মীদের বিশেষভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। তারা ভুল করলেও তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। তাদেরকে আরো সাহস দেওয়া হয়েছে, যে তারা একবার ভুল করলেও পরের বার তারা ঠিকই পারবে। এভাবে সুষ্ঠু ও সঠিক ট্রেনিং এর মাধ্যমে তাদেরকে কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। আশা করা যাচ্ছে যে পরবর্তীতে যদি ক্যাফেতে কোন নতুন কর্মী নিয়োগ করা হয়, তাহলে এই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কর্মীদের মাধ্যমেই ট্রেনিং দেওয়া হবে।

অপরচুনিটি ক্যাফের মালিকের কথা মতে এই ক্যাফের লভ্যাংশ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কর্মীদের মাঝেই বিতরণ করে দেওয়া হয়। তাছাড়া এই লভ্যাংশ থেকে তাদের দায়িত্বে থাকা আরও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর মাঝেও কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন। একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি যখন অপর কোন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির কাজে লাগতে পারেন এর থেকে ভালো আর কোন কিছু হয় না।

বর্তমান সমাজে অপরচুনিটি ক্যাফের প্রভাব:

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: অপরচুনিটি ক্যাফে সমাজের অবহেলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।  এই ব্যক্তিরাও যে সমাজের সম্পদ হতে পারে, ক্যাফে টি তার দৃষ্টান্তই প্রতিস্থাপন করে। তাই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে  অবদান রাখার সুযোগ দেওয়া উচিত।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন: ক্যাফেটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে সকল মানুষ, তাদের পটভূমি নির্বিশেষে, সমানভাবে স্বাগত, যা একটি সমাজের সহনশীলতা ও বৈচিত্র্যেরই প্রকাশ।

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি: ক্যাফেটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে, তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে এবং তাদের আত্মসম্মান বৃদ্ধি করে সমাজে ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেয়।

আশা ও অনুপ্রেরণা: অপরচুনিটি ক্যাফে সমাজের অবহেলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আশা ও অনুপ্রেরণার উৎস। পরিশ্রম ও উদ্যোমের মাধ্যমে যে কেউ সফল হতে পারে।

দিনশেষে ক্যাফেটি শুধু সুস্বাদু  খাবার খাওয়ারই জায়গা নয়, ক্যাফেটি অবহেলিত মানুষের জন্য একটি অবলম্বন। অপরচুনিটি ক্যাফের স্পেশাল মেসেজ হল সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির সম্ভাবনা ও মূল্য অপরিসীম। আমাদের সকলেরই সমানভাবে সুযোগ ও সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ক্যাফেটি আমাদের সকলকে সহানুভূতিশীল, গ্রহণযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে অবদান রাখার জন্য উৎসাহিত করে। প্রতিটি ব্যক্তিরই সমাজ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখার কিছু না কিছু আছে।
আমাদের অবশ্যই সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহায়ক হতে হবে।
বৈচিত্র্যই আমাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করে।

অপরচুনিটি ক্যাফে শুধু একটি ক্যাফে নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন যা আমাদের সকলকে আরও ভালো সমাজ গঠনে প্রতিনিধিত্ব করে।

 

আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন.

Writers,
Atiya Alam Nisa’s Team:

Sanjida Akter Nitu

Abdul Ahad

Samsul Alam Roni

Shamiha Thasin Boishak