সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। আজকের বৃদ্ধরা তাদের শৈশবে যেসব খেলাধুলা খেলেছিলেন, সেগুলো এখন আর দেখতে পান না। ভুলে গেছেন বহু খেলার নাম। একসময় গ্রামের শিশু ও কিশোররা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল। তারা অবসরে গ্রামের খোলা মাঠে দলবেঁধে খেলতো। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা এবং কালের বিবর্তনে এসব খেলা মহাকালের ইতিহাসে হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ খেলা আমাদের আদি ক্রীড়া সংস্কৃতির অংশ ছিল এবং একসময় আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করত।

আজ গ্রামীণ খেলাগুলো বিলুপ্ত হতে হতে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। পাড়াগাঁয়েও কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বৌচি, কানামাছি প্রভৃতি গ্রামীণ খেলার প্রচলন নেই। খো-খো, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, গোশত তোলা, চিক্কা, কুতকুত, কিং কিং খেলা, ল্যাংচা, বোমবাস্টিং, বৌচি, কাঠিছোঁয়া, দড়ি লাফানো, দড়ি টানাটানি, কানামাছি, ওপেন্টি বাইস্কোপ, নৌকাবাইচ, ঘোড়াদৌড়, নুনতা খেলা, পুতুল খেলা, ফুল টোকা, বউচি, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, লাটিম, ষাঁড়ের লড়াই, ষোল গুটি ইত্যাদি খেলাগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে।

  • পুতুল খেলা

ছেলে-মেয়ে, বর-কনে বিভিন্ন ধরনের পুতুল কাপড় ও গয়না দিয়ে সাজানো হয়। এই খেলার মাধ্যমে রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ের অভিনয় করা হয়। পুরো সংসারের একটা ছবি ফুটে ওঠে পুতুল খেলার মধ্যে। ছোট ছোট মেয়েরা মায়ের মতো তাদের পুতুল সন্তানদের স্নেহ-আদর দেয়, খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায় এবং প্রয়োজনে শাসনও করে। পুতুল খেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব হলো একজনের মেয়ের সঙ্গে আরেকজনের ছেলে পুতুলের বিয়ে দেয়া।

  • টোপাভাতি

পুতুল খেলার মতোই, টোপাভাতি/জুলাবাতি বা রান্না করার খেলা মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা। টোপা অর্থ মাটির হাঁড়ি-বাসন আর ভাতি মানে ভাত রান্না করা। কঞ্চি বা লাঠি দিয়ে ঘরের খুঁটি বানিয়ে, পাতার ছাউনি দিয়ে খেলাঘর তৈরি করা হয়। ঘর লেপা, চুলা তৈরি, খুদ দিয়ে ভাত রান্না, এবং ধুলোকে চিনি বা লবণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে কাল্পনিক বাজার করে মাছ-মাংস এবং বিভিন্ন তরকারি নিয়ে আসে।

মেলা থেকে কেনা টিনের বটি দিয়ে তরকারি কাটার কাজ চলে। খেলনা চুলো না থাকলে তিনটে ইট বা ঢেলা দিয়ে চুলা বানানো হয়। সেই চুলায় ফু দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়, যা দেখে মনে হয় বাস্তব সংসারেই সব চলছে। মুখ দিয়ে শব্দ করে পাতার থালায় খাওয়ার অভিনয় করা হয়। সবকিছু মিলিয়ে বাচ্চাদের মুখে থাকে অনাবিল আনন্দ।

  • চাড়া

এক্কাদোক্কা/চাড়া আমাদের দেশের শিশুদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল। ভাঙ্গা মাটির হাড়ি বা কলসির টুকরো দিয়ে চাড়া বানিয়ে বাড়ির উঠানে বা খোলা জায়গায় আয়তাকার দাগ কেটে খেলা হয়। ঘরের মধ্যে আড়াআড়ি দাগ টেনে ছয়টি খোপ তৈরি করা হয়। সরল নিয়মে এই খেলা একা বা বন্ধুদের সাথে খেলা যায়। চাড়া ছুড়ে, এক পায়ে লাফ দিয়ে দাগ পার হয়ে চাড়াটি পায়ের আঙ্গুলের টোকায় বাইরে আনতে হয়। দাগে পড়লে বা দুই পাশের রেখা পার হলে খেলোয়াড় দান হারায়। যে সব ঘর পার হতে পারে সে-ই এক্কাদোক্কায় জিতে যায়।

  • ওপেনটি বায়োস্কোপ:

মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা হলো ওপেনটি বায়োস্কোপ। এ খেলার সময় মজার ছড়া আওড়ানো হয়, যেমন,

“ওপেনটি বায়োস্কোপ,
নাইন টেন টুইস্কোপ,
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
রাজবাড়িতে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিংয়ের চাবি আঁটা”

খেলায় দুটি মেয়ে মুখোমুখি অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে পরস্পরের হাত ধরে উঁচু করে দরজার মতো বানিয়ে রাখে। তাদের তৈরি দরজার মাঝ দিয়ে অন্য মেয়েরা লাইন ধরে চক্রাকারে ঘুরে। এসময় সবাই মিলে সুরে সুরে ছড়াটি আবৃত্তি করে। ছড়ার শেষ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দরজা ধরে থাকা মেয়েরা তাদের হাত নামিয়ে সবচেয়ে কাছের মেয়েকে ধরে ফেললে সবাই মিলে তাকে ওপরে তুলে কিছুক্ষণ ঘুরায়। এভাবেই শেষ হয় ওপেনটি বায়োস্কোপ।

  • ডাঙ্গুলি

ডাঙ্গুলি বাংলাদেশের অল্প বয়সি ছেলেদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি খেলা। এটি অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত হলেও ডাঙ্গুলি নামেই বেশি পরিচিত। খেলার উপকরণ দেড় হাত লম্বা লাঠি (ডান্ডা) এবং ছোট কাঠি (গুলি)।

প্রথম দল গুলি ছুড়ে মারে, প্রতিপক্ষ সেটি লুফে নিতে চেষ্টা করে। ধরতে পারলেই খেলোয়াড় আউট। যদি না পারে, খেলোয়াড় বড় লাঠি দিয়ে গুলিটি দূরে পাঠায়। প্রতিপক্ষ কাঠিটি গর্তের দিকে ছোঁড়ে, যদি তা বড় লাঠিকে আঘাত করে তবে খেলোয়াড় আউট। এভাবে খেলা চলতে থাকে।

  • দাঁড়িয়াবান্ধা

দাঁড়িয়াবান্ধা বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হাডুডুর মতোই জনপ্রিয়। এতে অল্প বয়েসি ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও বড়রাও অংশ নেয়। খেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ছক বাধা ঘর। খেলা হয় দুটি দলের মধ্যে, প্রতিটি দলে ৫ থেকে ৯ জন খেলোয়াড় থাকে। মাটির উপর দাগ কেটে ঘরের সীমানা নির্ধারণ করা হয়।

প্রত্যেক ঘরের নির্দিষ্ট নাম আছে যেমন, বদন ঘর, লবণ ঘর, পাকা ঘর ইত্যাদি। খেলোয়াড়রা ঘরের সীমানার মধ্যে থেকে প্রতিপক্ষকে ছুঁতে চেষ্টা করে। যদি কোনো খেলোয়াড় ছোঁয়া বাঁচিয়ে সব ঘর ঘুরে আবার গদি ঘরে ফিরতে পারে তবে সে এক পয়েন্ট পায়। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় ছুঁয়ে ফেললে দল ঘাই হারায়। দ্রুত দৌড় এবং কৌশল প্রয়োগ করে খেলাটি জয়ী হওয়া যায়।

  • রুমাল চুরি

সব বন্ধুরা গোল হয়ে বসে খেলে রুমাল চুরি। একজন চোর হয়, অন্যেরা কেন্দ্রের দিকে মুখ করে বসে। চোর হাতে রুমাল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সুবিধামতো একজনের পেছনে অলক্ষ্যে রেখে দেয়। সে টের না পেলে চোর তার পিঠে কিল-চাপড় দেয়। টের পেলে বা মার খেয়ে রুমাল নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায় এবং এবার সে হয় চোর। আগের চোর তার জায়গায় বসে পড়ে।

গ্রামীণ খেলাগুলো আমাদের শিকড়ের সঙ্গে জড়িত। এগুলো হারিয়ে গেলে কেবল একটি ঐতিহ্য নয়, বরং শৈশবের একটি রঙিন অধ্যায়ও চিরতরে মুছে যাবে। তাই আমাদের উচিত এ সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা, যাতে নতুন প্রজন্ম তাদের শিকড়ের গল্প জানতে পারে।

এরকম আরও ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

লেখক
ফারদীন বিন আবদুল্লাহ 
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE