কখনো কী ভেবে দেখেছেন কেউ বাংলাদেশে বসে মহাকাশের অসাধারণ সব ছবি লিপিবদ্ধ করবেন? কখনো কী ভেবে দেখেছেন বাংলাদেশি প্রতিভা নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়েই মহাকাশের দূর-দূরান্তে রেখে যাবে নিজের প্রতিভার স্পর্শ? কালপুরুষ নেবুলার ছবি নিজের বানানো টেলিস্কোপে লিপিবদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের এক প্রতিভা জুবায়ের কাওলিন। এই ছবি তুলতে তাঁর লেগেছিল প্রায় ৪.৫ ঘন্টা। আর তিনি এই ছবি তুলে মহাকাশে নিজের গল্প লিখেছেন বাংলাদেশেরই ঢাকার কোনো এক ছাদে বসে। শুধু কালপুরুষ নেবুলায় নয়, তাছাড়া তুলেছেন মহাকাশের নানান প্রান্তের নানান গ্রহ-উপগ্রহের ছবি। চলুন আজ আমরা আরো জানবো জুবায়েরের সম্পর্কে।
ছোটবেলা থেকেই জুবায়ের ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমি এবং মেধাবী। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি প্রথম টেলিস্কোপ তৈরি করেন। লেন্সের গাণিতিক হিসাব নিকাশের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। সে সময়েই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন বড় হয়ে তিনি আরো ভালো মানের টেলিস্কোপ বানাবেন। মহাকাশ তাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করত। টেলিস্কোপের মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করতে চাইতেন মহাবিশ্বের এক অনন্য সৌন্দর্য। সেখান থেকেই শুরু। অবশেষে ২০১৯ সালে তিনি তৈরি করেন পূর্ণাঙ্গ টেলিস্কোপ। ২০২৪ সালের ২৮ শে অক্টোবর কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলে সৃষ্টি করেন ইতিহাস। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের তৈরি ৮-১০ কেজি ভরের প্রায় ৯০০ মিলিমিটারের একটি টেলিস্কোপ। সেখানে তিনি ব্যবহার করেছেন আলোক দূষণ কমাতে ন্যারোব্যান্ড ফিল্টার। প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টার এক্সপোজার শর্ট নেন তিনি।
তবে জুবায়েরের এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। তাঁকে সম্মুখীন হতে হয়েছে নানান ঘাত প্রতিঘাতের। জুবায়েরের কর্মজীবন শুরু হয় ভিএফএক্স এবং অ্যানিমেশন স্টুডিওর মাধ্যমে। ২০১০ সাল থেকে তিনি চালান নিজের অ্যানিমেশন স্টুডিও। এই অ্যানিমেশন করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি কেনেন ট্রাকিং মাউন্ট, ক্যামেরা এবং অন্যান্য সামগ্রী। তাছাড়া তিনি বিক্রি করা শুরু করেন নিজের তোলা ছবি। যদি এর থেকে তিনি বেশি অর্থ জোগাড় করতে পারেন নি। তবে কথা বলে, “পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না”। আর তাঁর পরিশ্রমও বৃথা যায় নি। সম্প্রতি তাঁর বানানো টেলিস্কোপ হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। শুধু তাই নয়, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সিও তাঁর কাজ যুক্ত করছেন তাদের প্লাটফর্মে। তাছাড়া সনি এবং নাসার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাঁর কাজ যুক্ত করছেন।
জুবায়ের কাওলিন আলোক দূষণের প্রতি খুবই সচেতন। তিনি কাজ করতে চান আলোক দূষণের বিরুদ্ধে। কারণ তিনি গভীর করতে চান মানবজাতির সাথে ঐ দূরের মহাবিশ্বের সম্পর্ক। উদঘাটন করতে চান মহাবিশ্বের অজানা সব রহস্য। ছবিতে তুলে ধরতে চান অসীম মহাবিশ্বের অসীম সৌন্দর্যকে। তাইতো তাঁর টেলিস্কোপে তিনি ব্যবহার করেন ন্যারোব্যান্ড ফিল্টার।
জুবায়েরের গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এবার আসি, তিনি কীভাবে তাঁর যন্ত্রপাতিসমূহ সংগ্রহ করে সে বিষয়ে। শুরুতে, টেলিস্কোপ তৈরি করতে তাঁকে কিনতে হয় একটি অবজেক্টিভ লেন্স। যার জন্য তাঁকে গুনতে হয় প্রায় ১০০-১৫০ ডলার। টেলিস্কোপ পাইপ তৈরি করেন তিনি নিজেই। এছাড়া বিভিন্ন যন্ত্রপাতি প্রায় তাঁর নিজেরই তৈরি। টেলিস্কোপ ছাড়াও তিনি একটি ট্রাকিং মাউন্ট ব্যবহার করেন। এটি তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনেন। তবে তিনি ২০১৯ সাল থেকে নিজের ট্রাকিং মাউন্ট বানানোর কাজ শুরু করেছেন। যা আমাদের জন্য একটি আশার খবর বলা যায়। তাছাড়াও তিনি মিরোর গ্রিডিং নিয়েও গবেষণা শুরু করেছেন। তিনি একটি মেশিন নির্মানেরও কাজ করছেন যা রিফ্লেক্টর লেন্স হিসেবে কাজ করবে।
ঢাকার নিজ বাসার ছাদ থেকে ৩৫০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা কালপুরুষ নেবুলার ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। তাঁর ছবিতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ধূলিমেঘ, নীহারিকার উজ্জ্বল তারকাবাজি এবং গ্যাসীয় ধূলিকণার সৌন্দর্য। তাঁর এই ছবি মনোযোগ কেড়েছে দেশের অগণিত মানুষের। তাঁর কাজ দেশ পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে বিদেশেও। আর এই কাজগুলো করতে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের তৈরি টেলিস্কোপ। পদে পদে রেখেছেন নিজের প্রতিভার সাক্ষর। আশা করি তিনি মহাবিশ্বের আরো অকৃত্রিম সৌন্দর্য এভাবেই মানবজাতির কাছে তুলে ধরবেন। এছাড়া নিয়ে আসবেন নিজের তৈরি আরো অনেক অনেক যন্ত্র। যা এদেশের তরুণ মহাকাশপ্রেমিদের ছুটিয়ে নিয়ে যাবে মহাকাশের অপূর্ব এক যাত্রায়। আশা করি বাংলাদেশের সরকার এরকম মেধাবীদের জন্য কাজ করে যাবেন এবং এই মেধাবীদের হাত ধরেই গর্বের সাথে বহির্বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমাদের দেশ।
এ রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
প্রত্যয় কান্তি দাশ
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE