নিকোলা টেসলা, সচারাচর তার নাম হয়তো আমারা তেমন শুনি না।কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আমরা তারই বিভিন্ন আবিষ্কার ব্যবহার করে থাকি।তিনি ছিলেন সেরা উদ্ভাবকদের একজন।আজ আমরা জানবো, হারিয়ে যাওয়া এই জিনিয়াস ব্যক্তি সম্পর্কে নানা জানা অজানা তথ্য।
নিকোলা টেসলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
১৮৫৬ সালের ১০ই জুলাই নিকোলা টেসলা জন্মগ্রহণ করেন।কথিত আছে টেসলার জন্মের সময় প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো, তাই অনেকে তখন তাকে চাইল্ড অফ ডার্ক বলতে থাকে।কিন্তু টেসলার মা তাদের বিরোধিতা করে বলেছিলেন টেসলা হবে চাইল্ড অফ লাইট।এবং তার মায়ের এই কথাটিই সত্য হয়।তার বাবা ছিলেন একজন ধর্ম যাজক। টেসলার বয়স যখন সাত বছর তখন তার ভাই এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনার নিহত হন।এটি তার মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল।১৮৭০ সালে টেসলা হাইস্কলে পড়ার সময়ে তার গনিত শিক্ষক মার্টিন সেকুলিক তাকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেন।১৮৭৩ সালে টেসলা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে গ্রাচ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ পদার্থ ও গনিত বিভাগে ভর্তি হন।এই সময়ে বিভিন্ন গবেষণার কাজে সময় দিতে গিয়ে তার স্বাস্থ্য ও পড়াশোনা উভয়েরই ক্ষতি হতে থাকে।টেসলা একসময় জুয়ায় আসক্ত হয়ে যান।শেষ বছরে পড়াশুনার সব খরচ তিনি জুয়া খেলায় হারিয়ে ফেলে আর পরীক্ষা দিতে পারেন নি এবং তিনি মানসিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন।পরবর্তীতে পড়াশোনা শেষ না করেই তিনি ১৮৮০ সালের দিকে বুদাপেস্ট এ চলে আসেন।এখানে তিনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এ কাজ করেন।এসময় তার মাথায় আসে আবেশী মটর উদ্ভাবনের ভাবনা।তবে তিনি সাফল্য পান নি।এরপর ১৮৮৪ সালে তিনি পাড়ি জমান আমেরিকায়।সেখানে তিনি আরেক বিখ্যাত উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসনের সাথে কাজ করার জন্য নিউইয়র্কে চলে যান।এটি তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল।তারপর থেকেই উদ্ভাবন করেছেন একের পর এক আবিষ্কার।
টেসলার উদ্ভাবন ও আবিষ্কার:
টেসলা বিদ্যুৎ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবহারের পথপ্রদর্শক ছিলেন।টেসলা ডিসি কারেন্ট এর বিপরীতে তৈরি করেন এসি কারেন্ট। এসি কারেন্ট বহুমুখী এবং অনেক দূরে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে সক্ষম।খুব দ্রুতই এসি কারেন্ট সকলের নিকট বেশ পরিচিতি লাভ করে। রেডিও বেতার আবিষ্কারেও টেসলার অবদান রয়েছে।টেসলা চেয়েছিলেন রেডিও বেতারের মতো করে কারেন্ট ও তারবিহীনভাবে একস্থান থেকে ইন্য স্থানে নিয়ে যেতে।এজন্য তিনি অনেক গবেষণা শুরু করেন।তিনি একটি টেসলা কয়েলও বানিয়ে ফেলেছিলেন।অর্থের অভাবে পরবর্তীতে এটি আলোর মুখ দেখে নি।জানা যায়,তিনশো’র মতো আবিষ্কার এর প্যাটেন্ট রয়েছে টেসলার নামে।নায়াগ্রা জলপ্রপাতে পাওয়ার স্টেশন স্থাপন করেছিলেন নিকোলা টেসলা। টেসলার আরো আবিষ্কার এর মধ্যে রয়েছে ইনডাকশন মটর,রিমোট, ফ্লুরোসেন্ট বাতি। বর্তমানে আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তা টেসলার মতবাদের ভিত্তিতেই চলছে।সারাবিশ্বে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে টেসলা এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন।
টেসলা এবং এডিসনের দ্বন্দ:
থমাস আলভা এডিসন ছিলেন আরেক বিখ্যাত উদ্ভাবক। ডিসি কারেন্ট এর উদ্ভাবক ছিলেন তিনি।কিন্তু টেসলার এসি কারেন্ট আবিষ্কারের পর তার ডিসি কারেন্ট এর জনপ্রিয়তা কমে যায়।এডিসন এরপর এসি কারেন্ট এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো শুরু করেন।তিনি বলতে শুরু করলেন এসি কারেন্ট এর ভোল্টেজ এত বেশি যে এটি মানুষ মেরে ফেলতে পারে।এমনকি এডিসন বলেছিলেন যে টেসলা নাকি হাতি মেরে ফেলেছিলেন।কিন্তু তারপরও কোনো কাজ হচ্ছিলো না।পরবর্তীতে এডিসন আরো একটি চক্রান্ত আকলেন।তিনি জেলে থাকা একজন কয়েদিকে ১০০০ ভোল্ট কারেন্ট দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু জেনারেটর এর চার্জ শেষ হয়ে যাওয়াতে কারেন্ট সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে জেনারেটর এর ভোল্টেজ ডাবল করে দেওয়া হয় এবং সে মারা যায়।এডিসন নিকোলা টেসলার বিরুদ্ধে কেস ও লড়েছেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেসটি টেসলাই জিতে যায়।
নিকোলা টেসলা ও পিরামিড রহস্য:
পিরামিডের আসল রহস্য এখনো উন্মোচন হয় নি।বিভিন্ন গবেষক এটি নিয়ে এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।পিরামিড কেন বানানো হয়েছিল? এই প্রশ্নটি এখনো অনেকের মনেই হানা দেয়।প্রখ্যাত মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ক্রিসটোফার ডান তার বইতে লিখেছেন, পিরামিড কে তখনকার সময়ে এনার্জি প্ল্যান্ট হিসেবে ব্যবহারের অনেক প্রমান পাওয়া গিয়েছে।পরবর্তীতে টেসলা বলেন পিরামিড আসলে একটি ওয়ারলেস পাওয়ার প্ল্যান্ট।তিনি পিরামিড নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন।এরপর এটির উপর ভিত্তি করেই তিনি তৈরি করলেন এক ড্রিম প্রজেক্ট, যেটির নাম উডেন ক্লিফ টাওয়ার প্রজেক্ট। টেসলা পিরামিডের মতো করে পৃথিবীর কম্পন ব্যবহার করে তার শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন।এবং তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পুরো বিশ্বে।লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে তিনি এই টাওয়ারের এক্সপেরিমেন্ট করেন।পরে তিনি দেখলেন এটি করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে।এজন্য তিনি জে.পি মরগানের দারস্থ হন।তবে টেসলা তার আসল উদ্দেশ্য লুকিয়ে অন্য প্রজেক্ট নাম করে অর্থ নেন। পরে তিনি আবার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন।কিন্তু এই অর্থ ও শেষ হয়ে যায়।তখন টেসলা তার এই এক্সপেরিমেন্ট এর শেষ পর্যায়ে ছিলেন।তখন তিনি আবার মরগানের কাছে গেলে তিনি আর অর্থ দেন নি।কারন সে টেসলার আসল উদ্দেশ্য জেনে গিয়েছিলেন।সে টেসলার প্রজেক্টটিও বন্ধ করে দেন।এর পিছে কারণ হলো মরগান ছিলেন জেনারেল ইলেক্ট্রিক এর মালিক,তার কপার মাইনের ব্যবসায় ছিলো,টিম্বার মিল ও আরো কারখানার মালিকও ছিলেন তিনি।যদি ওয়ারলেস ইলেকট্রিসিটি চালু হয়ে যেত তাহলে তার সব ব্যবসায় ধস নেমে যেত।এজন্য তিনি টেসলার প্রজেক্ট এ আর অর্থ দেন নি। যদি ঠিক মতো অর্থ পেয়ে টেসলা তার এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারতেন তাহলে হয়তো আজ পুরো বিশ্ব ওয়ারলেস কারেন্ট দিয়ে চলতো। সে সাথে পিরামিডের রহস্যও উন্মোচিত হয়ে যেত।
নিকোলা টেসলা তার শেষ বয়স অনেক দুর্দশার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।১৯৪৩ সালে নিউ ইউর্কার হোটেলের ৩৩ নাম্বার রুমে তিনি থাকতেন।জানুয়ারির ৮ তারিখ একজন মেইড সেই রুমে ঢুকলে দেখতে পান একটি নিথর দেহ পরে আছে।মানবজীবনে তার অসামান্য অবদান থাকলেও তাকে কোনো নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় নি। তবুও এই জিনিয়াস ব্যক্তি মানুষের কাছে আজীবন অমর হয়ে থাকবেন।
এরকম আরো ব্লগ পরতে, ক্লিক করুন
লেখক,
পিয়াস মাহমুদ
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE