সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের জানার ইচ্ছা ছিল অদম্য। মহাবিশ্বের সব রহস্য ভেদ করা মানুষের একরকম শখ বলা যায়। কারণ মানুষ প্রতিনিয়ত জানতে চায় সত্যকে। আঁকতে চায় নতুন দিগন্তের ছবি। অজানাকে জেনে বাড়াতে চায় নিজ জ্ঞানের পরিধি।
আমাদের এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই ক্ষুদ্র। এই মহাবিশ্বের অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা। আর এই মহাবিশ্বকে কাছ থেকে উপলব্ধি করার উপায় হতে পারে টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখা সম্ভব, সেই দূর আলোকবর্ষে থাকা গ্রহ,নক্ষত্র,ছায়াপথের সৌন্দর্য এবং করা সম্ভব বিস্তর গবেষণা। তাইতো, বিজ্ঞানিরা আবিস্কার করেছেন চমকপ্রদ এক টেলিস্কোপ যার নাম “জেমস ওয়েব”। হাবল টেলিস্কোপের পরে এটিই বিজ্ঞানীদের তৈরি সব থেকে সেরা একটি টেলিস্কোপ।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের বর্ণনা
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটির আবিষ্কার কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। এর নির্মান কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালে। এটি নাসা, ইএসএ, সিএসএ এর যৌথ প্রকল্প। ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ সালে এটিকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগের আলো সনাক্ত করতে সক্ষম। এটিতে ৬.৫ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট বিশাল আয়না। আয়নাটি সোনার প্রলেপযুক্ত। এটি হাবল টেলিস্কোপের আয়না হতে প্রায় ৬ গুণ বেশি শক্তিশালী। এটি ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যর মাধ্যমে তার কার্যক্রম চালায়। এটি প্রায় ১০ বছর সেবা দিতে সক্ষম। তবে বিজ্ঞানিরা প্রত্যাশা করছেন এটি ২০ বছর পর্যন্ত সেবা দিয়ে যাবে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের লক্ষ্য: অতীত দেখা কী সম্ভব?
এর উত্তর হলো অবশ্যই সম্ভব। কারণ আমরা যে আলো দেখি তা অতীতের বিষয়বস্তু আমাদেরকে দেখাই। যেমন সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ সেকেন্ড। তার মানে আমরা ৮ সেকেন্ড আগের আলো দেখি। তেমনই টেলিস্কোপ সেই আগের মহাবিশ্বকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপও তৈরি করা হয়েছে তাই। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানিরা সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করতে চাই। তাঁরা দেখতে চাই, কিভাবে নতুন নতুন নেবুলার জন্ম হয় এবং কীভাবে একটি নক্ষত্রের মৃত্যু হয়। জেমস ওয়েব শুধু সৃষ্টির রহস্য জানতেই নয়, তারই সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে বহির্জাগতিক প্রাণের সন্ধানে। এছাড়া এটি ব্যবহৃত হচ্ছে সৌরজগত সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে। এটি অবলোহিত বিকিরণের সাহায্যে প্রায় ১৩৫০ কোটি বছর আগের মহাবিশ্বকে অবলক্ষণ করতে সাহায্য করছে জেমস ওয়েব যে মহাকাশ গবেষণায় বড় ভূমিকা রাখছে তা বলাই যায়।
জেমস ওয়েবের তোলা ছবি এবং এটি স্থাপনের ফলাফল
২০২১ সালে উত্তোলনের পর থেকেই যেন তাক লাগিয়ে বেড়াচ্ছে জেমস ওয়েব। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদেরকে পাঠাচ্ছে মহাবিশ্বের অকৃত্রিম সুন্দর সব ছবি। এই ছবিগুলো খুলে দিচ্ছে মহাকাশ গবেষণায় নতুন দ্বার। চলুন জেনে নি, জেমসের ওয়েবের তোলা ছবিগুলো সম্পর্কে।
এসএমএসিএস ০৭২৩ গ্যালাক্সিপুঞ্জর ছবি: এটি জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম ছবি। মানুষের তোলা সবথেকে দূরের ছবি এটি। এই গ্যালাক্সিপুঞ্জে রয়েছে অসংখ্যা গ্যালাক্সির ছবি। সবথেকে বিষ্ময়কর বিষয় হলো, আমরা যে সেই গ্যালাক্সির যে ছবিটি দেখছি সেটি প্রায় ১৩৬০ কোটি বছরের অতীতের। অর্থাৎ, বিজ্ঞানির সেই ১৩৬০ কোটি বছর আগে কিভাবে গ্যালাক্সিটির শুরু এবং কিভাবে সেখানে নক্ষত্রের সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণার করার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে হয়তো সে গ্যালাক্সিটি আর নাও থাকতে পারে। তবে সেই ১৩৬০ কোটি বছর আগের ছবির সূত্র ধরে বিজ্ঞানিরা উন্মোচন করতে পারছেন মহাকাশে অসংখ্যা অজানা রহস্য।
ডব্লিউএএসপি-৯৬বি গ্রহ: ১১৫০ আলোকবর্ষে দূরে অবস্থিত এই গ্রহটির ছবি তুলেছে জেমস ওয়েব। এই গ্রহে গ্যাস, পৃথিবীর মতো মেঘ এবং কুয়াশা থাকার প্রমাণ মিলেছে। এই প্রমাণ, বহির্জাতিক প্রাণের সন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া অন্য গ্রহে বসবাসযোগ্য স্থান খুঁজতে এই ছবিগুলো গুরুত্ব অপরিসীম।
ওফিউচি অঞ্চল: ওফিউচি মূলত নক্ষত্র তৈরির কারখানা। ২০২৩ সালে নাসা জেমস ওয়েবের তোলা ওফিউচি অঞ্চলের ছবি প্রকাশ করে। এই ছবিতে দেখা যায় ৫০ টি শিশু নক্ষত্রের অবস্থান। এই ছবি নক্ষত্রের জন্ম এবং মৃত্যু সম্পর্কে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে তা বলাই যায়।
বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী সাফল্য জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এটি বিজ্ঞানকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। এটি প্রসার করেছে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রগুলো। শুধুমাত্র এসএমএসিএস ০৭২৩ গ্যালাক্সিপুঞ্জ, ডব্লিউএএসপি-৯৬বি গ্রহ,ওফিউচি অঞ্চলই ছবি নয় এটি আরো তুলেছে সাউদার্ন রিং নীহারিকা, ওয়াস্প ৯৬ বি, নেপচুনের বলয়, টারান্টুলা নীহারিকাসহ আরো অসংখ্য ছবি। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আগামীতে যে মহাবিশ্বের আরো বিষ্ময়কর সুন্দর ছবি আমাদের সামনে নিয়ে এসে অজানা অনেক কিছুর দরজা যে খুলে দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
প্রত্যয় কান্তি দাশ
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE